Home » ঘরে নিন্দিত, বাইরে নন্দিত একজন গর্বাচেভ

ঘরে নিন্দিত, বাইরে নন্দিত একজন গর্বাচেভ

0 মন্তব্য 364 ভিউজ

খুব কম বিশ্বনেতাকে মিখাইল সের্গেইভিচ গর্বাচেভের মতো অনিবার্য দুঃখজনক পরিণতি বরণ করতে হয়েছে। এক দিক থেকে সোভিয়েত ইউনিয়নের শেষ নেতা হিসেবে গর্বাচেভই সম্ভবত একমাত্র সত্যিকারের মানবিক ব্যক্তি ছিলেন।

দুঃখজনক বিষয় হলো, গর্বাচেভ এমন এক সময়ে মারা গেলেন, যখন তাঁর জন্মভূমি রাশিয়ায় রাজনৈতিক দমন-পীড়ন আবারও দমবন্ধ অবস্থায় পৌঁছে গেছে এবং শীতল যুদ্ধের সময় দীর্ঘকাল ধরে সংঘাতের যে অপচ্ছায়া গোটা ইউরোপকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল, সেই অপচ্ছায়া আজ বাস্তবে পরিণত হয়েছে।

এই ফলাফলগুলো গর্বাচেভ এড়াতে চেষ্টা করেছিলেন। তিনি এমন একজন ব্যক্তি ছিলেন, যিনি সোভিয়েত সমাজকে উন্মুক্ত করার চেষ্টায় যুক্ত হয়েছিলেন, বহু মতকে দমন করে রাখার পরিবর্তে আশাবাদ এবং সুস্থ বিতর্ককে উৎসাহিত করেছিলেন।

তিনি সোভিয়েত ইউনিয়নকে পুনরুজ্জীবিত করতে চেয়েছিলেন। তিনি এমন একটি শান্তির আসন্ন শতাব্দীর স্বপ্ন দেখেছিলেন, যেখানে সোভিয়েত ইউনিয়ন একটি ‘কমন ইউরোপিয়ান হোম’-এ যোগদান করবে।

গর্বাচেভের কৃতিত্ব বা অর্জন ছিল অসংখ্য। মার্কিন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যানের সঙ্গে বেশ কয়েকটি শীর্ষ সম্মেলনের সময় যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে অস্ত্র হ্রাস চুক্তির আলোচনা করা সেসব অর্জনের অন্যতম।

আইসল্যান্ডের রাজধানী রেকজাভিকে রিগ্যানকে তিনি যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের পারমাণবিক অস্ত্র নির্মূল করা উচিত বলে যে পরামর্শ দিয়েছিলেন, তা মার্কিন পররাষ্ট্রনীতি প্রতিষ্ঠানকে আঘাত করেছিল। তিনি ১৯৮৬ সালে প্রথম চেরনোবিল বিপর্যয়ের কথা স্বীকার করেছেন এবং বলেছিলেন, এ বিপর্যয় দেশের ভেতরে ও বাইরে তাদের ভাবমূর্তি নষ্ট করবে।

ব্যক্তি হিসেবে সোভিয়েত ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক পদ থেকে পদত্যাগ করেছেন। এরপর ইউনিয়ন ট্রিটি ভেঙে দিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে কনস্টিটিউয়েন্টগুলো বিচ্ছিন্ন ও সার্বভৌম হয়ে গেলে তিনি সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট পদও হারান। সোভিয়েত ইউনিয়নের মূল অংশ রাশিয়ার ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট ইয়েলৎসিন তখন জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে সোভিয়েত ইউনিয়নের আসন এবং তার পারমাণবিক অস্ত্রাগারের পুরোটাই উত্তরাধিকারসূত্রে পান।

তাঁর প্রেসিডেন্টের মেয়াদের শুরুর দিকে তিনি মার্গারেট থ্যাচারের (যুক্তরাজ্যের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী) সঙ্গে ব্যক্তিগত সুসম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন। থ্যাচার বিবিসিকে বলেছিলেন, গর্বাচেভ এমন একজন মানুষ, যাঁর সঙ্গে পশ্চিম ওঠাবসা-লেনদেন করতে পারে। গর্বাচেভ ১৯৮৮-৮৯ সালে আফগানিস্তান থেকে সোভিয়েত বাহিনী প্রত্যাহার করেছিলেন এবং স্বীকার করেছিলেন, সেখানে রুশ বাহিনীর উপস্থিতি আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন।

ওয়ারশ চুক্তিতে সই করা কমিউনিস্ট শাসিত দেশগুলোর নেতাদের উৎখাত করার জন্য সেসব দেশে যে স্বতঃস্ফূর্ত বিক্ষোভ হয়েছিল, তার অনেকগুলোতে তিনি হস্তক্ষেপ করতে অস্বীকার করেছিলেন।

এমনকি সেসব দেশের শাসকেরা যাতে নিজেদের নাগরিকদের বিরুদ্ধে বলপ্রয়োগ না করেন, সে জন্য তিনি তাঁদের চাপ দিয়েছিলেন। তবে সম্ভবত তিনি সোভিয়েত ইউনিয়নের ‘পেরেস্ত্রোইকা’খ্যাত অর্থনৈতিক পুনর্গঠন, ‘গ্লাসনস্ত’খ্যাত উন্মুক্ত উদার সমাজ গঠন এবং ‘দিমোক্রাতাইজাৎসিয়া’খ্যাত গণতন্ত্রমুখী রাজনীতি প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনার প্রধান স্থপতি হিসেবে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ছিলেন।

অন্যান্য এলাকার মতো রাশিয়ার স্তাভ্রোপলের কৃষকদের কাছ থেকে সোভিয়েত সরকার জোর করে জমি আত্তীকরণ করার পর যে চাষিরা ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন, তেমনই এক কৃষকের ঘরে ১৯৩১ সালে জন্ম নেওয়া গর্বাচেভ সোভিয়েত রাজনীতিকে প্রভাবিত করতে একটি প্রতিষ্ঠিত পথ অনুসরণ করেছিলেন। তরুণ বয়সে তিনি কমিউনিস্ট পার্টির যুব সংগঠন কমসোমল-এ যোগ দেন এবং মস্কো স্টেট ইউনিভার্সিটিতে আইন বিষয়ে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পান।

স্তাভ্রোপলের ফার্স্ট সেক্রেটারি এবং তারপর প্রদেশের পার্টিপ্রধান হওয়ার পর তিনি একজন মধ্যপন্থী সংস্কারক হিসেবে নিজের ভাবমূর্তি গড়ে তুলতে শুরু করেন এবং যে চাষি ফসল উৎপাদনে সরকারের বেঁধে দেওয়া লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যেতেন, তাঁদের বোনাস এবং ব্যক্তিগত মালিকানায় জমির প্লট দেওয়া শুরু করেন।

গর্বাচেভের রাজনৈতিক ক্যারিয়ার সেখানেই শেষ হয়ে যেতে পারত। কিন্তু অনেক সফল রাজনৈতিক অভিজাত ব্যক্তির মতো তিনি পৃষ্ঠপোষকতার নেটওয়ার্ক থেকে উপকৃত হয়েছিলেন। বিশেষ করে কমিউনিস্ট পার্টির মূল তাত্ত্বিক মিখাইল সুসলভ এবং কেজিবি প্রধান ইউরি আন্দ্রোপভ উভয়েই তাঁকে সোভিয়েত নেতৃত্বের একটি সম্ভাবনাময় নতুন মুখ হিসেবে দেখেছিলেন।

দুর্নীতির প্রবল প্রতিপক্ষ হিসেবে সুখ্যাতি পাওয়া গর্বাচেভকে প্রথমে পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটিতে এবং তারপর ইউএসএসআরের প্রধান নীতিনির্ধারক সংস্থা পলিটব্যুরোতে পদোন্নতি দেওয়া হয়।

১৯৮২ সালে কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক লিওনিদ ব্রেজনেভ মারা গেলে আন্দ্রোপভ দলের হাল ধরেন এবং গর্বাচেভকে অর্থনীতির ওপর ক্রমবর্ধমান নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা দেন। আন্দ্রোপভের মৃত্যুর পর এবং পার্টির সাধারণ সম্পাদক কনস্তান্তিন চেরনেনকো অসুস্থ হওয়ার পর ১৯৮৫ সালে পার্টির সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব নেওয়ার আগে পর্যন্ত গর্বাচেভ কার্যকরভাবে সোভিয়েত রাজনীতির দ্বিতীয় শক্তিধর ব্যক্তি ছিলেন।

গর্বাচেভকে পশ্চিমে স্নায়ুযুদ্ধের অবসান ঘটানো ব্যক্তি হিসেবে সম্মানিত করা হলেও তিনি নিজের দেশে প্রায় সমানভাবে একজন মূর্খ নেতা হিসেবে নিন্দিত হয়েছিলেন। রাশিয়ার মানুষ মনে করে, তিনি এমন কিছু নিয়ে এসেছিলেন, যা এমনকি তিনি নিজেই চাননি আর তা হলো সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন। তিনি ইতিহাসের মহান শান্তি প্রতিষ্ঠার অন্যতম অগ্রদূত হিসেবে ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রে সবচেয়ে বেশি স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। কিন্তু রাশিয়ানরা গর্বাচেভকে রাশিয়ার অস্থিতিশীলতা ও পতনের প্রতীক হিসেবে দেখবে।

আরও পড়ুন

মতামত দিন

আমাদের সম্পর্কে

We’re a media company. We promise to tell you what’s new in the parts of modern life that matter. Lorem ipsum dolor sit amet, consectetur adipiscing elit. Ut elit tellus, luctus nec ullamcorper mattis, pulvinar dapibus leo. Sed consequat, leo eget bibendum Aa, augue velit.