Home » ট্রানজিটের হিসাব-নিকাশ

ট্রানজিটের হিসাব-নিকাশ

0 মন্তব্য 465 ভিউজ

ট্রানজিটের পণ্য নিয়ে ভারত থেকে আসা দ্বিতীয় জাহাজ সম্প্রতি নোঙর করে চট্টগ্রাম বন্দরে। বন্দরের এনসিটি টার্মিনালের এক নম্বর জেটিতে গত মঙ্গলবার রাতে পৌঁছায় ট্রানজিটের জাহাজ এমভি ট্রান্স সামুদেরা। এর আগে ২০২০ সালের জুলাইয়ে আসে ট্রানজিটের প্রথম জাহাজ এমভি সেঁজুতি। প্রথম জাহাজে পণ্য ছিল চার কনটেইনার। দ্বিতীয় জাহাজের পরীক্ষামূলক চালানের যাবতীয় কার্যক্রম সফলভাবে শেষ করেছে বাংলাদেশ।

নৌ-ট্রানজিট বাংলাদেশ ও ভারতের অর্থনীতিতে কতটা প্রভাব ফেলবে, কে কতটুকু লাভবান হবে, কাকে কোন ধরনের অবকাঠামো তৈরি করতে হবে- তা নিয়ে চলছে নানা আলোচনা। বিশিষ্টজন বলছেন, দু’দেশের সম্পর্ক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে ট্রানজিট। চট্টগ্রাম বন্দর ও কাস্টমসের ভবিষ্যৎ সক্ষমতাও এ ক্ষেত্রে রাখবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।

 

ট্যারিফ কমিশনের কোর কমিটি ট্রানজিটের জন্য ইতোপূর্বে ১৩টি সম্ভাব্য রুট চিহ্নিত করেছে। এসব রুট ব্যবহার করে উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় সাতটি রাজ্যে পণ্য নেওয়া গেলে ভারতের পরিবহন ব্যয় কমে যাবে অর্ধেকের বেশি। অন্যদিকে পণ্য পরিবহন বাবদ বিভিন্ন ধরনের মাশুল পাবে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বন্দর, কাস্টম কর্তৃপক্ষ এবং সড়ক ও মহাসড়ক বিভাগ। বিনিময়ে ট্রানজিট পণ্য নিরাপদে পৌঁছে দেবে বাংলাদেশ। পণ্যবাহী সঠিক গন্তব্যে নিতে প্রয়োজনে নিরাপত্তারক্ষীও রাখতে হবে বাংলাদেশকে। ট্রানজিট পণ্যে কাস্টম কর্তৃপক্ষ সাতটি খাতে মাশুল আদায় করতে পারবে। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ মাশুল পাবে আটটি খাতে। সিঅ্যান্ডএফ প্রতিষ্ঠান কমিশন পাবে। সড়ক ও মহাসড়ক বিভাগ টোল পাবে। আবার চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ভারতীয় সীমান্ত পর্যন্ত নিতে ভাড়া পাবে বাংলাদেশের যানবাহন। ২০ ফুট দীর্ঘ পণ্যবোঝাই একটি কনটেইনারে সব মিলিয়ে খরচ হবে প্রায় ৫০ হাজার টাকা। তবে কনটেইনারপ্রতি মাশুলের পরিমাণ ১০ হাজার টাকারও কম হবে। মাশুলের বিষয়টি পণ্যের ধরন, ওজন ও দামের ওপর নির্ভর করে। সাধারণত ২০ ফুট দীর্ঘ একটি কনটেইনারে ১৪ টন পণ্য আমদানি করা যায়।

 

কেন ট্রানজিট চায় ভারত

অবস্থানগত সুবিধার কারণেই চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহার করতে চায় ভারত। ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলার সঙ্গে কলকাতার দূরত্ব এক হাজার ৬৮০ কিলোমিটার। অথচ চট্টগ্রাম বন্দর থেকে আগরতলার দূরত্ব মাত্র ২৪৮ কিলোমিটার। মেঘালয়ের রাজধানী শিলংয়ের সঙ্গে কলকাতার দূরত্ব ১ হাজার ১৫০ কিলোমিটার হলেও চট্টগ্রাম বন্দর থেকে এ দূরত্ব মাত্র ৫৭০ কিলোমিটার। মিজোরামের রাজধানী আইজলের সঙ্গে চট্টগ্রাম বন্দরের দূরত্ব ৬৫৫ কিলোমিটার হলেও কলকাতার দূরত্ব ১ হাজার ৫৫০ কিলোমিটার। নাগাল্যান্ডের রাজধানী কোহিমার সঙ্গে বন্দরের দূরত্ব ৮৮০ কিলোমিটার হলেও কলকাতার দূরত্ব ১ হাজার ৪৫০ কিলোমিটার। কলকাতা থেকে অন্যান্য রাজ্যের দূরত্বও চট্টগ্রামের তুলনায় গড়ে তিন গুণের বেশি। উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় সাত রাজ্যে এখন কলকাতা বন্দর থেকে ফিডার জাহাজে করে পণ্য পরিবহন করতে হচ্ছে ভারতকে। এতে ভারত সরকারের সময় ও অর্থ দুটিই বেশি যাচ্ছে। বাংলাদেশের ওপর দিয়ে সাত রাজ্যে পণ্য পরিবহন শুরু হওয়ায় এখন আগের চেয়ে ভারতের খরচ কমে যাবে অর্ধেকেরও বেশি।

কেন সময় নিয়েছে বাংলাদেশ

বাংলাদেশের ওপর দিয়ে ভারত ট্রানজিট চাইছে অনেক আগে থেকেই। কিন্তু সময় নিয়েছে বাংলাদেশ। চট্টগ্রাম বন্দর ও কাস্টমসের সক্ষমতা বাড়ানো হয়েছে। সেসঙ্গে তৈরি করা হয়েছে সড়ক অবকাঠামোও। আগে ঢাকা-চট্টগ্রাম সড়ক চার লেন ছিল না। ট্রানজিট নিয়ে আলোচনার মধ্যেই চার লেন করা হয়েছে। চট্টগ্রাম বন্দরে স্ক্যানারের সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে। আনা হয়েছে বেশ কয়েকটি নতুন ক্রেন। চট্টগ্রাম কাস্টমস অটোমেশনের আওতায় আনা হয়েছে। বাড়ানো হয়েছে লোকবলও। তবে চট্টগ্রাম বন্দরে কাস্টমসের সক্ষমতা আরও বাড়াতে হবে। সব গেটে দেওয়ার মতো স্ক্যানার নেই কাস্টমসের। বিস্ম্ফোরক পণ্য শনাক্ত করতে নেই পর্যাপ্ত যন্ত্রপাতি। সংকট আছে দক্ষ জনশক্তিরও। সড়ক অবকাঠামোও টেকসই হয়নি এখনও। আট লেনের মহাসড়ক এখন সময়ের দাবি।

যেভাবে অবসান হয় এক যুগের অপেক্ষার

বাংলাদেশের ওপর দিয়ে ভারতের সাত রাজ্যে পণ্য পরিবহনের আলোচনা চলছে অনেক বছর ধরে। তবে তা জোরালো হয়েছে গত এক দশক ধরে। ২০১০ সালে ভারত প্রস্তাবনা তুলে ধরে বাংলাদেশের কাছে। ট্রানজিটের সক্ষমতা যাচাই করে দেখতে ২০১২ সালে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি বিশেষ ওয়ার্কিং কমিটি গঠন করে বাংলাদেশ। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, নৌ মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র্র মন্ত্রণালয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, রেল মন্ত্রণালয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও বন্দর কর্তৃপক্ষের প্রতিনিধি নিয়ে গঠিত হয়েছিল এ ওয়ার্কিং কমিটি। ট্রানজিট কিংবা ট্রান্সশিপমেন্টের অর্থনৈতিক সুবিধা কাজে লাগাতে সড়ক, রেল ও নৌপথের বিদ্যমান অবকাঠামো ও ভবিষ্যৎ প্রয়োজনীয়তা নির্ধারণ করে কিছু সুপারিশ করে এ ওয়ার্কিং কমিটি। তখন তারা চট্টগ্রাম বন্দরের সর্ববৃহৎ ক্ষমতাসম্পন্ন নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল পুরোদমে চালু করা, মোংলা বন্দরের তিনটি জেটি দ্রুত ব্যবহার উপযোগী করা, পর্যাপ্ত আধুনিক যন্ত্রপাতি সংযোজন এবং মোংলা-খুলনা রেলপথ দ্রুত নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করতে সুপারিশ করে। তাদের এ সুপারিশের ভিত্তিতে গত ছয় বছরে কিছু নতুন অবকাঠামো হয়েছে দুই বন্দরে। তবে সড়ক ও রেলপথে আসেনি কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন। তারপরও এগোতে থাকে আলোচনা। ২০১৮ সালের অক্টোবরে দিল্লিতে উভয় দেশের সচিব পর্যায়ে এ ব্যাপারে চুুক্তি হয়। ২০১৯ সালের ৫ অক্টোবর ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লিতে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এ সংক্রান্ত এসপিও বা পরিচালন পদ্ধতির প্রক্রিয়াতে সই করেন। এর দেড় বছর পর পরীক্ষামূলকভাবে শুরু হয় পণ্য পরিবহন। প্রথম চালান আসে ২০২০ সালের জুলাইয়ে। দ্বিতীয় চালান আসে গত মঙ্গলবার রাতে।

কোন রুটে ভারতের কত সাশ্রয়

উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় সাতটি রাজ্যে পণ্য নিতে চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর ব্যবহার করতে পারলে অর্থ ও সময় সাশ্রয় হবে ভারতের। অনেক কমে যাবে তাদের দূরত্বও। ট্যারিফ কমিশনের কোর কমিটি ট্রানজিট হলে কোন রুট দিয়ে পণ্য নিলে কার কত অর্থ সাশ্রয় হবে সে ব্যাপারে তাদের রিপোর্টে একটি ধারণা দিয়েছে। প্রতিবেদন অনুসারে তামাবিল-চট্টগ্রামে ১২ শতাংশ, আখাউড়া-চট্টগ্রামে ৭০ শতাংশ, আখাউড়া-বেনাপোলে ৪৮ শতাংশ, সুতারকান্দি-বেনাপোলে ৩৩ শতাংশ, সুতারকান্দি-চট্টগ্রামে ৫৩ শতাংশ, বাংলাবান্ধা-মোংলা ২৯ শতাংশ, বুড়িমারী-মোংলা ১২ শতাংশ, শাহবাজপুর-চট্টগ্রাম ৬৭ শতাংশ, আখাউড়া-দর্শনা ৭০ শতাংশ, রায়মঙ্গল-আশুগঞ্জে প্রায় ৫০ শতাংশ এবং শাহবাজপুর-দর্শনা রুটে ট্রানজিট সুবিধা পেলে ভারতের সাশ্রয় হবে ৫৭ শতাংশ খরচ।

৭০০ থেকে ৮০০ ডলার পেতে পারে বাংলাদেশ

বন্দর, কাস্টম, সিঅ্যান্ডএফ, পরিবহনসহ সবমিলিয়ে ২০ ফুট দীর্ঘ একটি কনটেইনারে বাংলাদেশের আয় হতে পারে ৭০০ থেকে ৮০০ ডলার। প্রথম জাহাজে চারটি কনটেইনারে ১০৩ টন পণ্য আসে। এসব পণ্য বাবদ ২০২০ সালে সব মিলিয়ে বাংলাদেশ পেয়েছে প্রায় ৫৯ হাজার টাকা। দ্বিতীয় জাহাজে এসেছে ২৫ টন রড। এখানে শিপিং এজেন্ট থেকে ৪৩ ডলার ও কনসাইনি থেকে ১ হাজার ৮০০ টাকা বন্দর কর্তৃপক্ষ আয় করেছে বলে জানান বন্দরের সচিব ওমর ফারুক। তবে সব মিলিয়ে এ চালানে বাংলাদেশ কত পেয়েছে তা এখনও চূড়ান্ত করে বলতে পারেনি কেউই।

আট খাতে মাশুল পাবে বন্দর

ট্রানজিট পণ্য পরিবহন বাবদ চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষকে আলাদা কোনো মাশুল দিতে হবে না ভারতকে। বিদেশি বাণিজ্যিক জাহাজের মাশুলও প্রযোজ্য হচ্ছে না তাদের জন্য। উপকূলীয় এলাকায় চলাচল করা অন্যান্য জাহাজের মতো ট্রানজিট পণ্যেও আটটি খাতে মাশুল পাবে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। পাইলট চার্জ, রিভার ডিউজ, বার্থিং চার্জ, ল্যান্ডিং চার্জ, টাগ চার্জ, পোর্ট ডিউজ, পণ্য ওঠানামার লিপটন চার্জ ও আনবার্থ চার্জ পাবে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। জাহাজের আকার, পণ্যের ধরন ও ওজনের ওপর নির্ধারিত হবে এসব চার্জ।

সাত ধরনের ফি পাবে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ

ভারতীয় পণ্য পরিবহনের সময় সাত ধরনের ফি আদায় করবে বাংলাদেশের কাস্টম কর্তৃপক্ষ। এর মধ্যে প্রতি চালানে প্রসেসিং ফি ৩০ টাকা, প্রতি টনের জন্য ট্রান্সশিপমেন্ট ফি ৩০ টাকা, নিরাপত্তা মাশুল ১০০ টাকা, এসকর্ট মাশুল ৫০ টাকা, প্রশাসনিক মাশুল ১০০ টাকা এবং প্রতি কনটেইনারের স্ক্যানিং ফি ২৫৪ টাকা। এর বাইরে প্রযোজ্য হারে দিতে হবে ইলেকট্রিক সিলের মাশুল। সব মিলিয়ে বন্দর ও কাস্টম কর্তৃপক্ষ প্রতি কনটেইনার পণ্যে শুধু মাশুল বাবদ আদায় করবে প্রায় ১০০ ডলার। সিঅ্যান্ডএফ প্রতিষ্ঠান পণ্যের দামের ওপর ভিত্তি করে কমিশন নেয়। ৫ লাখ টাকা দামের পণ্যের জন্য তারা এক শতাংশ হারে কমিশন নেয়। আবার পণ্যের দাম ২০ লাখ টাকার বেশি হলে তারা দশমিক ২৫ শতাংশ হারে কমিশন পাবে। এর বাইরে সড়কপথে প্রতিটি কনটেইনার আগরতলা পর্যন্ত নিতে বাংলাদেশি যানবাহনকে ভাড়া বাবদ গড়ে ৪০০ থেকে ৫০০ ডলার বা ৩২ থেকে ৪০ হাজার টাকা দিতে হবে। তবে ভারত থেকে প্রতি বছর কী পরিমাণ ট্রানজিট পণ্য আসা-যাওয়া করবে তা এখনও চূড়ান্ত নয়। তাই এ খাতে বছর শেষে আসলে কত টাকা পাবে বাংলাদেশ তা চূড়ান্ত করে বলা যাচ্ছে না।

আরও পড়ুন

মতামত দিন


The reCAPTCHA verification period has expired. Please reload the page.

আমাদের সম্পর্কে

We’re a media company. We promise to tell you what’s new in the parts of modern life that matter. Lorem ipsum dolor sit amet, consectetur adipiscing elit. Ut elit tellus, luctus nec ullamcorper mattis, pulvinar dapibus leo. Sed consequat, leo eget bibendum Aa, augue velit.