প্রথমে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেওয়া, তারপর গণভোটের আয়োজন, সবশেষে রুশ ফেডারেশনে অন্তর্ভুক্ত করার ঘোষণা— ইউক্রেনের খেরসন, জাপোরিঝঝিয়া, দোনেৎস্ক ও লুহানস্ক অঞ্চল ঘিরে এই ধারাবাহিকতায় এগিয়েছেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন।
ইউক্রেনের ওই চার অঞ্চল রাশিয়ার সঙ্গে পাকাপাকিভাবে যুক্ত করতে গতকাল শুক্রবার ক্রেমলিনে এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। সেখানে ওই অঞ্চলগুলোকে রাশিয়ার ‘নতুন অংশ’ হিসেবে ঘোষণা করেন পুতিন। স্বাক্ষর করা হয় এ সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় নথিপত্রে।
শুধু সংযুক্তির ঘোষণা দিয়েই থেমে থাকেননি রুশ প্রেসিডেন্ট। যে কোনো উপায়ে অঞ্চলগুলো রক্ষা করা হবে বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। বলেছেন, অঞ্চলগুলোর নিয়ন্ত্রণ কখনোই ছেড়ে দেবে না মস্কো।
ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর সাত মাস পর হঠাৎ কেন পুতিনের এই সংযুক্তির ঘোষণা, চলমান যুদ্ধে এর কী প্রভাব পড়বে আর এই ঘোষণার জেরে পরিস্থিতি আরও কতটা উত্তপ্ত হবে— এমন সব প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করা হয়েছে সংবাদমাধ্যম বিবিসির এক প্রতিবেদনে।
এখনই কেন এই সংযুক্তি
যুদ্ধক্ষেত্রে ইউক্রেনীয় বাহিনীর তীব্র প্রতিরোধের মুখে সম্প্রতি হোঁচট খায় রুশ বাহিনী। এরই মধ্যে অনেকটা হুট করে খেরসন, জাপোরিঝঝিয়া, দোনেৎস্ক ও লুহানস্ক অঞ্চলে গণভোটের আয়োজন করে ক্রেমলিন। যদিও এই ভোটাভুটি মেনে নেয়নি ইউক্রেন ও দেশটির পশ্চিমা মিত্ররা।
গণভোটে অঞ্চলগুলোর বেশিরভাগ অধিবাসী রাশিয়ার সঙ্গে যুক্ত হওয়ার পক্ষে রায় দেন বলে খবর আসে রুশ গণমাধ্যমগুলোতে। এরপরই শুক্রবার অঞ্চলগুলো রাশিয়ার সঙ্গে যুক্ত করার ঘোষণা দিলেন পুতিন।
ইউক্রেনের চার অঞ্চলকে রাশিয়ার অংশ হিসেবে ঘোষণার পর এখন সেনাসদস্যদের সেখানকার ‘ফ্রন্টলাইনে’ পাঠানো যাবে। ফ্রন্টলাইন বলতে বোঝানো হয়েছে যে এলাকায় সম্মুখ যুদ্ধে অংশ নেন দুই পক্ষের সেনারা। মস্কোর ভাষ্য, এই ফ্রন্টলাইন ১ হাজার কিলোমিটারের বেশি দীর্ঘ।
এ ছাড়া চারটি অঞ্চলকে যুক্ত করার পর সেগুলোকে রুশ ভূখণ্ড দাবি করার সুযোগ তৈরি হয়েছে পুতিনের। এখন সেখানে হামলা চালানোর জন্য ইউক্রেনীয়দের অব্যাহতভাবে অস্ত্র ও ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে সহায়তা করলে পশ্চিমা দেশগুলোকে হুমকি দিতে পারবেন তিনি।
ক্রিমিয়ার সঙ্গে মিল কতটুকু
২০১৪ সালের মার্চেও একই পথে হেঁটেছিল রাশিয়া। সে বছর ইউক্রেনের ক্রিমিয়া অঞ্চল দখল করে নেয় মস্কো। পরে গণভোটের মধ্য দিয়ে ক্রিমিয়াকে রাশিয়ার সঙ্গে যুক্ত করার ঘোষণা দেন পুতিন। তবে ক্রিমিয়া দখলে রক্ত ঝরেছিল খুবই কম। আর রাশিয়া পুরো অঞ্চলটিই দখল করতে পেরেছিল।
এবারের চিত্র ভিন্ন। দোনেৎস্ক ও লুহানস্কের বড় অংশ ২০১৪ সাল থেকে মস্কোপন্থী বিচ্ছিন্নতাবাদীদের হাতে ছিল। গত সাত মাসের যুদ্ধে দোনেৎস্কের ৬০ শতাংশ অঞ্চল নিজেদের নিয়ন্ত্রণে এনেছে রুশ বাহিনী। কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ লিমান শহর অল্প কিছু সময়ের মধ্যেই রুশ বাহিনীর হাতছাড়া হতে পারে।
অপরদিকে জাপোরিঝঝিয়ার রাজধানী এখনো ভালোভাবেই ইউক্রেনীয়দের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। যদিও রুশ ক্ষেপণাস্ত্রের আওতায় রয়েছে। রাশিয়ার সঙ্গে যুক্ত করা আরেক অঞ্চল খেরসনের খুব কাছাকাছি রয়েছেন ইউক্রেনের সেনারা।
কী পরিবর্তন আসবে
পরিবর্তনটা এখনো স্পষ্ট নয়। ইউক্রেনের অঞ্চলগুলো নিজেদের বলে ঘোষণা দেওয়ার পর রাশিয়ার নতুন সীমান্ত কীভাবে নির্ধারণ করা হবে, তার সুস্পষ্ট ধারণা দিতে পারেননি ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভও। তিনি এটুকু বলেছেন, দোনেৎস্কের পুরোটাই রাশিয়ার। এ অঞ্চলের যেসব এলাকা এখনো দখলে নেই, সেগুলো ভবিষ্যতে ‘স্বাধীন’ করা হবে।
গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেন অভিযান শুরুর আগে দোনেৎস্ক ও লুহানস্ককে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিল রাশিয়া। আর পুতিনের শুক্রবারের ঘোষণার পর এই দুই অঞ্চলকে এখন রাশিয়া অংশ হিসেবে ধরবে মস্কো। অপরদিকে যুক্ত করার আগে জাপোরিঝঝিয়া ও খেরসনকেও একইভাবে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা দেন রুশ প্রেসিডেন্ট।
চার অঞ্চলকে রাশিয়ায় অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়টি যাবে রুশ পার্লামেন্টের উভয়কক্ষে। নিম্নকক্ষ ডুমায় এই চার অঞ্চলকে রুশ ফেডারেশনে অন্তর্ভুক্ত করতে সংবিধান সংশোধন বিল পাস করা হবে। সেখান থেকে যাবে পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষ ফেডারেশন কাউন্সিলে। সেখানে পাস হলে যাবে পুতিনের কাছে। এরপর তিনি তাতে চূড়ান্ত অনুমোদন দেবেন। আগামী শুক্রবার পুতিনের ৭০তম জন্মদিন। এর আগেই সব প্রক্রিয়া শেষ করা হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
সময়টা কতটা ঝুঁকির
পুতিনের মনে কী চলছে, তা প্রকৃতপক্ষে কেউই জানে না। তবে সম্প্রতি সময়ে তাঁর পশ্চিমাবিরোধী মনোভাব নতুন স্তরে পৌঁছেছে। ফলে এটা স্পষ্ট যে, তিনি পশ্চিমা দেশগুলোকে এটাই বোঝাতে চাচ্ছেন যে, রাশিয়ার অন্তর্ভুক্ত করা চার অঞ্চলে ইউক্রেন হামলা চালালে, তা রাশিয়ার ওপরে হামলা বলেই ধরবে মস্কো।
এ ক্ষেত্রে প্রশ্ন উঠছে, রাশিয়ার এই মনোভাব ইউক্রেন যুদ্ধক্ষেত্র ও যুদ্ধক্ষেত্রের বাইরে কতটা প্রভাব ফেলবে? এরই মধ্যে যে কোনো উপায়ে নিজেদের ভূখণ্ড রক্ষা করা হবে বলে হুমকি দিয়েছে পুতিন। তাঁর হুমকিতে বাদ পড়েনি পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের বিষয়টিও। আর তাঁর প্রতিরক্ষামন্ত্রী সের্গেই শোইগু বলেছেন, ইউক্রেনের চেয়ে পশ্চিমাদের বিরুদ্ধেই বেশি লড়ছে মস্কো।
রাশিয়ার পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের হুমকিকে অবশ্য আমলে নিচ্ছে না ইউক্রেন। ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান কার্নেগি এনডোমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল পিসের গবেষক পল স্ত্রোনস্কি বলেন, মস্কোর এসব হুমকি-ধমকি দিচ্ছে মূলত পশ্চিমা দেশগুলোকে ভয় দেখাতেই।