গত বৃহস্পতিবার রাতে উপর্যুপরি কয়েকটি বিস্ফোরণের শব্দে ঘুম ভাঙে ইয়াঙ্গুনবাসীর (সাবেক রেঙ্গুন)। ওই রাতে ইয়াঙ্গুনের উপকণ্ঠে মিঙালাডন টাউনশিপের একটি সেনা ছাউনিতে আক্রমণ চালায় গণতন্ত্রপন্থী মিলিশিয়া বাহিনী পিপলস ডিফেন্স ফোর্সের (পিডিএফ) গেরিলারা। ইয়াঙ্গুন-মান্দালয় হাইওয়ের নিকটবর্তী ওই ছাউনিতে পিডিএফের কেউ হতাহত হয়নি।
একই রাতে মিঙালাডন টাউনশিপেই বর্মি বিমান বাহিনীর আরেকটি ছাউনিতে বোমা বিস্ফোরণ ঘটায় ওয়ার অব হান্টার রেভল্যুশন (ডব্লিউওএইচ) নামে আরেক গেরিলা গোষ্ঠী। দুটি ঘটনায় তাতমাদোর (বর্মি সামরিক বাহিনীর আনুষ্ঠানিক নাম) কতজন হতাহত হয়েছে সে বিষয়ে আনুষ্ঠানিক কোনো বক্তব্য দেয়নি মিয়ানমারের সামরিক জান্তা। তবে পিডিএফের মতো ডব্লিউওএইচের গেরিলাদেরও কেউ হতাহত হয়নি বলে গোষ্ঠীটির এক আনুষ্ঠানিক বক্তব্যে দাবি করা হয়েছে।
দুটি ঘটনার পরেই ইয়াঙ্গুনের টাউনশিপগুলোয় জান্তা অনুগত নিরাপত্তা বাহিনীর টহল বেড়েছে। মিয়ানমারের বাণিজ্যিক ও সাংস্কৃতিক রাজধানী ইয়াঙ্গুনের ওপর জান্তার নিয়ন্ত্রণ ক্রমেই দুর্বল করে তুলেছে গেরিলারা। মূল ইয়াঙ্গুন শহরসহ গোটা প্রদেশকেই এখন সামরিক জান্তার বড় দুঃস্বপ্নের জায়গায় পরিণত করেছে।
ইয়াঙ্গুনে গেরিলা হামলায় বিপর্যস্ত তাতমাদো সৈন্যদের ক্ষোভের বলি হচ্ছে সাধারণ বেসামরিক নাগরিকরা। শুধু বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায়ই পৃথক তিনটি ঘটনায় ইয়াঙ্গুনের সাত বাসিন্দাকে গুলি করে হত্যা করেছে বলে স্থানীয় বাসিন্দাদের বরাত দিয়ে রেডিও ফ্রি এশিয়া জানিয়েছে। এর মধ্যে একটি ঘটনায় অজ্ঞাতনামা এক গেরিলার হামলায় এক সৈন্যের মৃত্যুর পর সেখানে একদল সৈন্য এসে গুলি চালায়। এ সময় এক পান দোকানদার ও দুই পথচারীর মৃত্যু হয়। সৈন্যের ওপর হামলা চালানো অজ্ঞাতনামা ওই গেরিলা এর আগে নিরাপদেই সেখান থেকে সরে যেতে সক্ষম হয়।
একসময় ইয়াঙ্গুন ছিল সুশৃঙ্খল নাগরিকের শহর। ব্রিটিশ আমল থেকেই বার্মা অঞ্চলের অর্থনীতির মূল কেন্দ্রবিন্দু শহরটি। তাতমাদোর ক্ষমতা দখলের পর শহরটি হয়ে ওঠে সামরিক জান্তাবিরোধী বিক্ষোভের অন্যতম প্রধান কেন্দ্র। জান্তার নিপীড়নের মুখে বিক্ষোভকারীরা অস্ত্র হাতে তুলে নিলে শহরটি পরিণত হয় গেরিলা যুদ্ধের ক্ষেত্র হিসেবে।
গোটা মিয়ানমারেই এখন সামরিক জান্তার ওপর আক্রমণের তীব্রতা বাড়িয়েছে পিডিএফ। এর সঙ্গে সমন্বয় করে আরাকান আর্মির মতো স্থানীয় সশস্ত্র গ্রুপগুলোও তাদের আক্রমণ বাড়িয়েছে। গত তিনদিনে মিয়ানমারে শুধু পিডিএফ গেরিলাদের আক্রমণেই ষাটের বেশিসংখ্যক জান্তা অনুগত সৈন্যের মৃত্যু হয়েছে বলে স্থানীয় সংবাদমাধ্যমগুলো জানিয়েছে।
দি ইরাওয়াদ্দি জানিয়েছে, উপর্যুপরি গেরিলা হামলা ও সম্মুখযুদ্ধে মারাত্মক ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়েছে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী। তাতমাদো এখন ইতিহাসের সবচেয়ে খারাপ সময় পার করছে। বাহিনীর প্রায় প্রতিটি ব্যাটালিয়নেরই যুদ্ধ সক্ষমতা মারাত্মকভাবে হ্রাস পেয়েছে। বয়স্ক সৈন্যের অনুপাতে তরুণদের সংখ্যা কমছে। এর সঙ্গে সঙ্গে হ্রাস পাচ্ছে নৈতিক মনোবলও। প্রতিটি সম্মুখযুদ্ধেই এখন দেখা যাচ্ছে আর্টিলারি বা বিমান বাহিনীর সহায়তা ছাড়া লড়াই করতেই পারছে না সৈন্যরা। আবার অফিসার ক্যাডেট বা সৈনিক নিয়োগ দিতে গিয়েও বড় ধরনের সমস্যায় পড়তে হচ্ছে। উপায়ান্তর না দেখে দমকল, পুলিশ ও প্রশাসনের চাকুরে বা জান্তাপন্থী পিউ স তি মিলিশিয়াদেরই নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য হিসেবে লড়াইয়ের ময়দানে ঠেলে দেয়া হচ্ছে। এসব বাহিনী বা গোষ্ঠী থেকে দলত্যাগ করে পিডিএফ বা স্থানীয় মিলিশিয়াগুলোয় যোগদানের প্রবণতাও এখন বাড়ছে। সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন জেনারেলদের মধ্যেও অভ্যন্তরীণ কোন্দল এখন বড় আকার নিয়েছে। রাখাইন, কাচিন বা ইয়াঙ্গুনের মতো যেসব এলাকায় এখন লড়াইয়ের তীব্রতা বাড়ছে, সেসব এলাকায় তাতমাদোর এসব সংকট দিনে দিনে আরো বড় হয়ে দেখা যাচ্ছে।
স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলোর তথ্য অনুযায়ী, পিডিএফসহ স্থানীয় মিলিশিয়াদের আক্রমণে বর্মি তাতমাদোর অবস্থা এখন প্রায় দিশেহারা। এরই মধ্যে মিয়ানমারের বড় একটি অঞ্চল রীতিমতো মুক্তাঞ্চল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বাকি যেসব এলাকা তাতমাদোর নিয়ন্ত্রণে সেগুলোয়ও পিডিএফ ও আঞ্চলিক বাহিনীগুলোর আক্রমণের তীব্রতা দিনে দিনে বাড়ছে। যদিও অনেক ক্ষেত্রেই এসব আক্রমণের রেশ ধরে বেসামরিক নাগরিকদের ওপর বর্মি সামরিক জান্তার নিপীড়ন বৃদ্ধিরও অভিযোগ রয়েছে।
মিয়ানমারে সামরিক বাহিনীর নৈতিক সংকট এখন অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় বেশি বলে দাবি করছেন স্থানীয়রা। নীতি-নৈতিকতার দিক থেকে জনসাধারণের কাছ থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে তাতমাদো। এ বিষয়ে ইরাওয়াদ্দির এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, জান্তা বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে সৈনিকের পেশাগত নীতিনৈতিকতার লেশমাত্র অবশিষ্ট নেই। মিয়ানমারের যেসব এলাকায় এখনো মুক্তাঞ্চল গড়ে তোলা যায়নি, সেসব এলাকায় বেসামরিক ব্যক্তিদের এখন তাতমাদো সৈন্যদের নানা নির্যাতনের মধ্য দিয়ে দিন পার করতে হচ্ছে। ডাকাতি, মুক্তিপণের জন্য অপহরণ, রাহাজানিসহ নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে তারা। সব মিলিয়ে গোটা মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীতেই বিশৃঙ্খলা এখন মারাত্মক আকার ধারণ করেছে।
অন্যদিকে পিডিএফ এবং স্থানীয় দলগুলোর প্রতি জনসাধারণের সমর্থন এখন দিনে দিনে বাড়ছে। অং সান সু চির ন্যাশনাল লিগ অব ডেমোক্রেসি (এনএলডি) এবং বিভিন্ন প্রদেশের স্থানীয় রাজনৈতিক দলগুলোকে নিয়ে ঘোষিত জাতীয় ঐকমত্যের সরকার ন্যাশনাল ইউনিটি গভর্নমেন্টের (এনইউজি) সশস্ত্র উইং হিসেবে পরিচালিত হচ্ছে পিডিএফ। ইয়াঙ্গুনসহ মিয়ানমারের বিভিন্ন অঞ্চলে পিডিএফের সাফল্য এ মুহূর্তে আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকদের নজর কেড়েছে।
এ বিষয়ে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম ফেডেরালে প্রকাশিত এক নিবন্ধে বলা হয়েছে, মিয়ানমারে জান্তা সরকারের আয়ু হয়তো আর খুব বেশিদিনের নয়। এরই মধ্যে দেশটির বিভিন্ন অঞ্চলের ওপর দিন দিন নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছে জান্তা সরকার। এ অবস্থায় ভারত সরকারেরও মিয়ানমারকেন্দ্রিক পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে নতুন করে ভাববার সময় এসে গিয়েছে।
অন্যদিকে বর্তমান প্রেক্ষাপটে এনইউজির কর্তাব্যক্তিরাও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেতে প্রচার-প্রচারণা শুরু করেছেন। এরই মধ্যে একদল এনইউজি প্রতিনিধি মালয়েশিয়াসহ আসিয়ানভুক্ত দেশগুলোর পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সঙ্গে এ নিয়ে দেখা করেছেন।