দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠার পর ১৯৪৮ সালের ১০ ডিসেম্বর মানবাধিকার ঘোষণাপত্র গৃহীত হয়। এতে প্রায় ৩০টি ধারায় মানুষের মৌলিক অধিকার রক্ষা করার তাগিদ দেয়া হয়েছে। মৌলিক অধিকার বলতে মানুষের অন্ন, বস্ত্র, চিকিৎসা, শিক্ষা ও বাসস্থানের অধিকারই শুধু নয়, মানুষের নিজের মতো জীবন ধারণ, ব্যক্তি স্বাধীনতা, ধর্মীয় অধিকার, মত প্রকাশের স্বাধীনতাসহ একজন মানুষের পরিপূর্ণ বিকাশে অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টির জন্য যেসব অধিকার ও সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত হওয়া দরকার সেগুলোর প্রতি জাতিসংঘ গুরুত্ব দিয়েছিল। জাতিসংঘ চেয়েছে যে, ধর্ম-বর্ণ, গোত্র, জাতি, লিঙ্গ নির্বিশেষে সব মানুষ বেঁচে থাকার সমান অধিকার নিয়ে পৃথিবীতে জীবনযাপন করবে। জাতিসংঘের এই ধারণার সঙ্গে কারো দ্বিমত পোষণ করার কোনো অবকাশ নেই। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে পৃথিবীতে এখনো বৈষম্য বোধ, বিদ্বেষ, হানাহানি এবং যুদ্ধ-বিগ্রহসহ ক্ষমতা ও অর্থবিত্তের ব্যাপক প্রভাব সর্বত্রই বিরাজ করছে। এমন অবস্থার মধ্যেও জাতিসংঘ মানবাধিকার ঘোষণা যখন গ্রহণ করে তখন এটিকে কেউই প্রত্যাখ্যান কিংবা বিরোধিতা করেনি, তবে বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ জাতিগোষ্ঠী সমানভাবে উদ্যোগী হয়নি। ১৯২টি রাষ্ট্র মানবাধিকার ঘোষণাপত্র গ্রহণ করলেও এ পর্যন্ত মাত্র ২৬টি রাষ্ট্র নিজ নিজ দেশে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন গঠন করার মাধ্যমে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে কম-বেশি ভূমিকা রেখে আসছে। বাংলাদেশ ২০০৯ সালে প্রথম জাতীয় মানবাধিকার কমিশন গঠন করে। এর আগে আমাদের দেশে কিছু কিছু বেসরকারি সংস্থা মানবাধিকার নিয়ে সোচ্চার থাকার চেষ্টা করেছে; তবে সবার উদ্দেশ্য এক রকম ছিল তা বলা যাবে না। কেউ কেউ জাতিসংঘের মানবাধিকার ঘোষণাপত্রের নীতিমালা অনুসরণ করার চেষ্টা করেছে, আবার কেউ কেউ পশ্চিমা দুনিয়ার কোনো কোনো দেশের অর্থায়নে এখানে মানবাধিকার নিয়ে নানাভাবে কথা বলেছে। ফলে মানব অধিকারের বিষয়টি আমাদের দেশে দীর্ঘ সময় লেগেছিল মানুষের কাছে পৌঁছাতে।
সমাজে মানুষের অধিকার বাস্তবায়ন করার ধারণাটি শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্য থেকে যেমনিভাবে বিকশিত হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয় একইভাবে রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ব্যবস্থার মাধ্যমেও এর বিস্তার ঘটাতে হয়। এখানে মূল সমস্যাটি মানুষকে দেখা, বোঝা, ভালোবাসা, শ্রদ্ধা করা এবং সবার সমান অধিকারকে স্বীকার করে নেয়ার দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করা একটি মৌলিক বিষয়। সেটি গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে রাষ্ট্র রাজনীতি, শিক্ষা ও সংস্কৃতির একটি ব্যাপক দৃষ্টিভঙ্গিগত পরিবর্তন হওয়ার আবশ্যকতা যেমন রয়েছে একইভাবে সেই পরিবর্তন সাধনে অগ্রসর চিন্তাধারার রাজনীতি, সংস্কৃতি ও শিক্ষার ধারক-বাহকদের ভূমিকা নিরবচ্ছিন্ন রাখা অপরিহার্য- এতে কোনোরকম দ্বিধা নেই।বাংলাদেশ ২০০৯ সাল থেকে মানবাধিকার কমিশন গঠনের মাধ্যমে দেশে মানুষের অধিকার সুনির্দিষ্ট নীতিমালা বিধি-বিধান এবং আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে বাস্তবায়ন করার অভিযাত্রা শুরু করেছে। তবে রাতারাতি এই অভিযাত্রায় বড় ধরনের সাফল্য কেউ আশা করতে পারে না। তারপরও এ পর্যন্ত গঠিত কমিশনগুলো দেশে মানবাধিকার বিষয়ে কম-বেশি সোচ্চার থাকার চেষ্টা করে আসছে। এর পাশাপাশি কিছু কিছু বেসরকারি মানবাধিকার সংস্থা ইতিবাচক ভূমিকা রেখে আসছে আবার কিছু কিছু নামধারী মানবাধিকার সংগঠন মানবাধিকারের সাংগঠনিক সুবিধা নিয়ে হীন ও সংকীর্ণ রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনের চেষ্টা এখনো করছে; এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ ২০১৩ সালের ৫ মে শাপলা চত্বরে হেফাজত ইসলামের তাণ্ডবকে সরকার কৌশলে নিয়ন্ত্রণ করার পর একাধিক তথাকথিত মানবাধিকার সংগঠন দেশে-বিদেশে গণহারে মানুষ হত্যার অপপ্রচার ও বানোয়াট ছবি প্রচার করেছে। ফলে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশে মানবাধিকার সম্পর্কে একটি ভুল বার্তা দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। এ ধরনের সংগঠনকে প্রকৃত মানবাধিকার সংগঠন হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া যায় না; তারপরও মানবাধিকার সংগঠনের নামে এ ধরনের কিছু কিছু সংগঠনের অস্তিত্ব ও কর্মকাণ্ড বাংলাদেশে রয়েছে। এরাই বিভিন্ন সময়ে জাতিসংঘ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইইউর সরকারের কাছে নানা ধরনের গুম, হত্যা ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ করে আসছে। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে ওইসব সংস্থা কখনো কখনো অভিযোগ প্রমাণিত হওয়া না হওয়ার আগেই মানবাধিকার লঙ্ঘনের নানা অভিযোগ উত্থাপন করে থাকে। বলাবাহুল্য নানা ধরনের লবিস্ট ফার্ম এখন পশ্চিমা দুনিয়ায় সরকার ও বিভিন্ন সংস্থাকে প্রভাবিত করার জন্য কাজ করে থাকে। পশ্চিমা দুনিয়ার শক্তিধর রাষ্ট্র ভূরাজনৈতিক স্বার্থে অনেক সময় লবিস্টদের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে আমাদের মতো দেশগুলোর ওপর চাপ সৃষ্টি করার চেষ্টা করে থাকে। কখনো কখনো নিষেধাজ্ঞা আরোপেও তা গড়ায়। এর ফলে মানবাধিকারের লক্ষ উদ্দেশ্য বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বাস্তবায়ন করা জটিল হয়ে উঠেছে। কারণ পশ্চিমা কোনো দেশ বা সংস্থা কর্তৃক উত্থাপিত মানবাধিকার, গুম, খুন বিষয়ে যে কোনো সমালোচনা, শর্ত ও নিষেধাজ্ঞা নিয়ে দেশের অভ্যন্তরে রাজনীতি ঘোলাটে হয়ে উঠে; প্রকৃত ঘটনা উদঘাটনের চেয়ে বিদেশি অভিযোগ সমাজ ও রাজনীতিতে মুখ্য হয়ে উঠে অথচ আমাদের মতো পশ্চাৎপদ শিক্ষা-সংস্কৃতির সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থার দেশে পশ্চিমা ধাঁচে বা মানে গণতন্ত্র, মানবাধিকারসহ অনেক কিছুই অর্জন বেশ সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। এটি অনেক সময় পশ্চিমা দেশগুলোর সরকার এবং বিভিন্ন সংস্থা কতটা বুঝে কিংবা তাদের উদ্দেশ্য সাধনে ব্যবহার করে সেটি এখন বিতর্কের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। মানব অধিকারের বিষয়টি এখন পশ্চিমা দুনিয়ার হাতে রাজনৈতিক ইস্যু হিসেবে দাঁড়িয়েছে। এর প্রমাণ মেলে সম্প্রতি নরওয়েভিত্তিক বিশ্ব শান্তি নোবেল পুরস্কার দেয়ার ক্ষেত্রে রাশিয়া-ইউক্রেন ও বেলারুসিয়ান ৩টি মানবাধিকার সংস্থাকে ভূষিত করেছে। এই পুরস্কার কতটা রাজনৈতিক, কতটা শান্তির পক্ষে সহায়ক সেটি সহজেই অনুমেয়। সুতরাং বিশ্বে এখন মানবাধিকারের বিষয়গুলো কতটা আন্তর্জাতিকভাবে শক্তিধর রাষ্ট্রগুলোর রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে, সেটিও এখন আর কেউ অস্বীকার করতে পারছে না।
মানবাধিকারের নামে কোনো কোনো সংগঠন ব্যক্তি বা গোষ্ঠী মিথ্যা তথ্য প্রদানের মাধ্যমে জাতিসংঘের মতো আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং অন্যান্য প্রভাবশালী দেশ ও সরকারকে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়ার একটি হীন চেষ্টা চালিয়েছে। কিন্তু এরই মধ্যে সেসব সংগঠনের দেয়া তথ্য এবং তালিকা প্রশ্নের মুখে পড়েছে। ফলে মানবাধিকার বিষয়ে বাংলাদেশে কিছু কিছু সংস্থা এবং রাজনৈতিক দল হীন রাজনৈতিক উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতে সচেষ্ট, এটি প্রমাণিত হয়েছে। অথচ বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বর্বরতম নজির যথেষ্টসংখ্যক ছিল। ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ড, জেল হত্যা, সামরিক বাহিনীর অভ্যন্তরে হাজার হাজার নিরপরাধ সামরিক বাহিনীর সদস্যকে হত্যা, তাদের লাশ গুম করে দেয়া, পরিবারগুলোকে এসব হত্যাকাণ্ডের কারণ সম্পর্কে কোনো তথ্য না দেয়া, চাকরির সুযোগ-সুবিধা বঞ্চিত করা ইত্যাদির কথা সবারই জানা বিষয়। পরবর্তী সময়েও অসংখ্য মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা বাংলাদেশে ঘটেছিল। ২০০১ থেকে ২০০৬ সালে রাষ্ট্র ও সরকারের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে অসংখ্য মানুষ হত্যা, নির্যাতন, ধর্মীয় বিশ্বাসের কারণে সব অধিকার থেকে বঞ্চিত হওয়ার ভূরি ভূরি প্রমাণ রয়েছে। কিন্তু ওইসব সংগঠন আমাদের জাতীয় জীবনের এসব মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ড, মানবাধিকার লঙ্ঘন ইত্যাদিকে সবসময়ই এড়িয়ে চলার বা উপেক্ষা করার চেষ্টা করেছে। এখানেই মানবাধিকারের দৃষ্টিভঙ্গিগত পার্থক্য রাজনৈতিকভাবে চলে এসেছে।
কিন্তু আমরা চাই দেশে মানবাধিকারের বিষয়গুলো আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে বিচার-বিশ্লেষণ এবং প্রমাণসাপেক্ষে কার্যকর করার উদ্যোগ সরকার ও মানবাধিকার সংগঠনগুলো যৌথভাবে বাস্তবায়ন করার চেষ্টা করবে। মানবাধিকার সংগঠনগুলো দেশপ্রেম, মানবতাবাদ, অসাম্প্রদায়িকতা, গণতন্ত্র, স্বাধীনতা এবং মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের প্রতি বিশ্বস্ত থেকে মানুষকে সহযোগিতা প্রদানে গ্রাম থেকে শহর পর্যন্ত সর্বোচ্চ সক্রিয় থাকবে। একই সঙ্গে মানুষের মধ্যে সচেতনতা বোধ তৈরি করবে। সরকারকেও প্রকৃত মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলোকে আইনানুগভাবে মোকাবিলা ও সমাধান করতে হবে। রাষ্ট্রের কোনো ব্যক্তি বা সংস্থা আইনের ঊর্ধ্বে নয়। সুতরাং মানবাধিকার বাস্তবায়নের দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক আইন, বিধিবিধান, ঘোষণাপত্র ইত্যাদি আমাদের যথাযথভাবে অনুসরণ করে চলতে হবে। সে ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক মহলগুলোরও দায়িত্ব রয়েছে আমাদের মতো দেশকে আমাদের মতো করে সহযোগিতা প্রদান করার, কোনো ভূরাজনৈতিক স্বার্থ কিংবা অভ্যন্তরীণ দলীয় প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীর ফাঁদে পা না দেয়া, মানবাধিকারকে রাজনৈতিক হীন স্বার্থের শিকারে পরিণত না করা। এটিকে জাতিসংঘের বিঘোষিত নীতি হিসেবে কার্যকর করার সুযোগ আমাদের দিতেই হবে।
মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী : অধ্যাপক (অবসরপ্রাপ্ত), ইতিহাসবিদ ও কলাম লেখক।