প্রায় ৫০ বছর আগে যে স্বপ্নের সূচনা হয়েছিল ধীরে ধীরে তা বাস্তবে রূপ পাচ্ছে। একেকটি ইট-বালুকণার গাঁথুনিতে দাঁড়িয়ে উঠছে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র। বাস্তবায়নকারী দেশ রাশিয়া থেকে প্রতিদিনই আসছে অবকাঠামো তৈরিতে নানা যন্ত্রপাতি। তেল- গ্যাসের বিকল্প জ্বালানি ইউরেনিয়াম দিয়ে দুই ইউনিটে মোট ২৪শ’ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হবে এই কেন্দ্র থেকে। প্রথম ইউনিটের রিঅ্যাক্টর ভেসেল আগেই বসেছিল। বুধবার বসল দ্বিতীয় ইউনিটের রিঅ্যাক্টর ভেসেল। যার উদ্বোধন করলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। রিঅ্যাক্টর ভেসেলকে বলা হয় পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের হৃৎপি-। এটি স্থাপনের মাধ্যমে পারমাণবিক বিদ্যুতে সাফল্যের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছল বাংলাদেশ। আর এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রকে ঘিরে পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলার রূপপুর যেন পরিণত হচ্ছে কোনো রূপকথার রাজ্যে।
বিদ্যুৎ কেন্দ্র সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রিঅ্যাক্টর ভেসেল পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ। দুই ইউনিটেই এটি স্থাপনের মাধ্যমে প্রকল্পটি নির্ধারিত সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়েই এগিয়ে যাবে। ওই কেন্দ্রের যে যন্ত্রে নিউক্লিয়ার ফুয়েল (পারমাণবিক জ্বালানি) ইউরেনিয়াম থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়, তার মূল কাঠামো হচ্ছে এই বিশেষ যন্ত্র, পারমাণবিক চুল্লি।
এর আগে গত বছরের ১০ অক্টোবর প্রথম ইউনিটের রিঅ্যাক্টর প্রেসার ভেসেল স্থাপন কার্যক্রমের উদ্বোধন করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। স্বাধীনতার পর গত ৫০ বছরের মধ্যে এই প্রকল্পই দেশের সবচেয়ে বড় এবং অর্থনৈতিক দিক থেকে সর্বাধিক ব্যয়বহুল প্রকল্প। রাশিয়ার সর্বাধুনিক প্রযুক্তি, আর্থিক ও প্রকল্প বাস্তবায়নসহ সার্বিক সহযোগিতায় বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির কাজ চলছে দ্রুতগতিতে।
জানা যায়, এতে স্থাপন করা হচ্ছে রাশিয়ার উদ্ভাবিত সর্বশেষ প্রযুক্তি থ্রিজি (প্লাস) ভিভিইআর ১২০০ মডেলের রিঅ্যাক্টর। রোসাটম প্রকৌশল শাখা এ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে। পরিকল্পনা অনুযায়ী, ২০২৩ সালের শেষ দিকে প্রথম ইউনিট থেকে এক হাজার ২০০ মেগাওয়াট এবং ২০২৪ সালের শেষ দিকে দ্বিতীয় ইউনিট থেকেও এক হাজার ২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হবে।
প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি চালু হলে টানা ৬০ বছর কার্বন নিঃসরণ ছাড়াই বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব হবে। তবে অনেক ক্ষেত্রে পারমাণবিক এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রের আয়ুষ্কাল আরও ২০ থেকে ৩০ বছর বাড়ানো যায়। সে হিসাবে ৮০-৯০ বছর পর্যন্ত বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব হবে। একই সঙ্গে প্রচলিত জ্বালানি দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনে যে খরচ হচ্ছে, তার চেয়ে অনেক সাশ্রয়ী মূল্যে এখান থেকে বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে।
বর্তমানে এই প্রকল্পটিতে ৩৩ হাজার জনবল কাজ করছে। তার মধ্যে বিদেশী জনশক্তি রয়েছে সাড়ে ৫ হাজার। প্রকল্প পরিচালক ড. শৌকত আকবর জনকণ্ঠকে বলেন, প্রকল্পটি সম্পন্ন করতে খরচ হবে ১২.৬৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এই প্রকল্পের ৯০ শতাংশ টাকা ঋণ দিচ্ছে রাশিয়া। একই সঙ্গে আন্তঃরাষ্ট্রীয় কয়েকটি চুক্তির মাধ্যমে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি নির্মাণ করছে রুশ ঠিকাদার এটমস্ট্রয় এক্সপোর্ট। বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের পাশাপাশি এটি পরিচালনার জন্য জনবলও তৈরি করে দিচ্ছে রাশিয়া। রয়েছে প্রতিপক্ষ রাষ্ট্র ইউক্রেনের কর্মীরাও। আর এ বিশাল পরিমাণ রাশিয়ানদের পদচারণায় অন্য রকম রূপ পাচ্ছে ছোট্ট গ্রাম রূপপুর। এখানকার জনজীবন এই প্রকল্প শুরুর আগে দেশের আর দশটা গ্রামের মতোই সাধারণ একটি গ্রাম থাকলেও রাশিয়ানদের উপস্থিতিতে এসেছে অর্থনৈতিক পরিবর্তন। গ্রামের প্রায় প্রতিটি বাড়ির কর্মক্ষম সদস্যই পেয়েছেন যোগ্যতা অনুযায়ী বিদ্যুৎ কেন্দ্রে চাকরি। যারা চাকরি পাননি বা করেননি তারাও করছেন পছন্দসই ব্যবসা। যেগুলোর মূল গ্রাহক বিদ্যুৎ কর্মীরা। ফলে দারিদ্র্য কি তা ভুলে গেছে এই গ্রামের বাসিন্দারা। গ্রামের বাসিন্দা মিষ্টি পান বিক্রেতা সোহেলের মুখে তাই স্বস্তির হাসি। নিজে চাকরি না করলেও বড় ছেলেটা বিদ্যুৎ কেন্দ্রে চাকরি করছে জানিয়ে তিনি বলেন, চাকরি থেকে ছেলের আয় তো রয়েছেই পাশাপাশি আমার ব্যবসাও চলছে খুব ভালো। পানের সঙ্গে সঙ্গে দোকানে আমি নানা ধরনের নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস রাখি। যেগুলো রাশিয়ানরা কিনে নেয়। তাই ব্যবসাও খুব ভালো হয়। পরিবার লইয়া খুব সুখে আছি। এখন আর অর্থকষ্ট আগের মতো নেই। ভালো আছেন বিদ্যুৎ কেন্দ্র সংলগ্ন রাশিয়ান মার্কেটের একটি শোরুমের বিক্রেতা ইকবাল হোসেনও। তিনি বলেন, পরিবারের বড় ছেলে হিসেবে বাবা মারা যাওয়ার পর আর পড়ালেখা করতে পারিনি। পরিবারের সবার দায়িত্ব এসে পড়ে আমার কাঁধে। এদিকে যথেষ্ট লেখাপড়া না থাকায় কোথাও চাকরিও হচ্ছিল না। তাই ঢাকা থেকে গার্মেন্টস পণ্য কিনে এনে এখানে ব্যবসা শুরু করি। রাশিয়ানদের কাছে আমাদের কাপড়ের খুব চাহিদা। এরপর আর পেছনে তাকাতে হয়নি। ৫ বছর আগে যে পুঁজি নিয়ে দোকান শুরু করেছিলাম তা আজ বহুগুণ হয়েছে। পরিবার নিয়ে সুখে আছি।
এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি থেকে উৎপাদন শুরু হলে শুধু রূপপুর নয় এমনভাবে ভাগ্য পরিবর্তন হবে উত্তরাঞ্চলের বহু মানুষের। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ বিষয়ে বলেন, আজকে বাংলাদেশের জন্য বিরাট অর্জনের দিন। এটা আমাদের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। বাংলাদেশের মানুষের জন্য অত্যন্ত সম্মান বয়ে আনবে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, রূপপুর কেন্দ্র থেকে যে বিদ্যুৎ আসবে, সেটা উত্তরবঙ্গের জন্যই ব্যবহার হবে। তারাই লাভবান হবে বেশি। সেখানে শিল্পকারখানা গড়ে উঠবে। আরও বেশি কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে। আর্থ-সামাজিক উন্নতি হবে।
শান্তি ও উন্নয়নের জন্য বাংলাদেশ পরমাণু শক্তির ব্যবহারে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র শুধু বিদ্যুৎ কেন্দ্র না, এটা একটা দৃষ্টান্ত, আমরা এ ধরনের একটা কাজ করতে পারি। পরিবেশ ঠিক রেখে আমরা ২৪শ’ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনে যাচ্ছি। যা আমাদের দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে বিরাট অবদান রাখবে।
এই প্রকল্পের সামগ্রিক অগ্রগতি সম্পর্কে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমন্ত্রী স্থপতি ইয়াফেস ওসমান বলেন, এই কেন্দ্রের প্রথম ইউনিট ২০২৩ সালে ১,২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ করবে এবং ২০২৪ সালে দ্বিতীয় ইউনিট থেকে একই পরিমাণ বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে।
প্রকল্পটির প্রায় ৫৩ শতাংশ আর্থিক অগ্রগতি এবং ৫৫ শতাংশ ভৌত অগ্রগতি হয়েছে। তবে প্রথম ইউনিটের সার্বিক অগ্রগতি ৭০ শতাংশ। এটি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হওয়া মানে বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশের সক্ষমতার জানান দেয়া।
প্রসঙ্গত, রূপপুর প্রকল্পটি রাশিয়ার কারিগরি ও আর্থিক সহায়তায় বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন বাস্তবায়ন করছে। জনশক্তি প্রশিক্ষণসহ প্রকল্পটির নির্মাণ ব্যয় ১২ দশমিক ৬৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং এর ৯০ শতাংশ রাশিয়ার অর্থায়নে করা হচ্ছে।
বিদ্যুৎ বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে ক্যাপটিভ ও নবায়নযোগ্য জ্বালানিসহ বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ২৫ হাজার ৭৩০ মেগাওয়াট। সক্ষমতার তালিকায় রূপপুরের বিদ্যুৎ যুক্ত হলে উৎপাদন সক্ষমতা সাড়ে ২৭ হাজার মেগাওয়াট ছাড়িয়ে যাবে।
ডিজেলে প্রতিইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদনে ২৫-৩০ টাকা, আমদানি করা এলএনজিতে ১০ টাকা খরচ হয়। সেখানে রূপপুরে প্রতিইউনিট বিদ্যুত উৎপাদন খরচ পড়বে ৫ টাকার মতো। ফলে বিদ্যুতের দাম মানুষের নাগালের মধ্যেই থাকবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
পূর্ববর্তী পোস্ট