আওয়ামী লীগ এবং এর অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের সব পর্যায়ের নেতার আমলনামা তৈরি করা হয়েছে। অন্য দল থেকে আওয়ামী লীগের অনুপ্রবেশকারীদের আদ্যোপান্তও উঠে এসেছে একটি বিশেষ সংস্থার তৈরি করা অতি গোপনীয় প্রতিবেদনে।
প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার কাছে জমা দেয়া ওই প্রতিবেদনে ব্যক্তির নাম, বতর্মান ও স্থায়ী ঠিকানা, বয়স, শিক্ষাগত যোগ্যতা, জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বর, মোবাইল ফোন নম্বর, অতীত কর্মকাণ্ড, স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি, আয়ের উৎস, পারিবারিক পরিচিতি, ছাত্রজীবনে রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা, ইতিবাচক ও নেতিবাচক কর্মকাণ্ড, সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড, অনুপ্রবেশের পর সংগঠনের কোনো নেতা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে পৃষ্ঠপোষকতা করছেন বা মদত দিচ্ছেন- তা উল্লেখ করা হয়েছে। আছে বিগত জাতীয় সংসদ ও স্থানীয় সরকার নির্বাচনে ভূমিকার তথ্যও
প্রতিবেদনে অনুপ্রবেশকারী এবং বিভিন্ন অপকর্মে জড়িত বিতর্কিতদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ পৃষ্ঠপোষক বা মদতদাতা হিসেবে অনেক মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও সংসদ সদস্যের নাম উঠে এসেছে। তালিকায় সংগঠনের কোনো পদে নেই; অথচ তাদের কারণে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে- এমন ব্যক্তিদের কর্মকাণ্ডের পূর্ণাঙ্গ বিবরণ রয়েছে। অনেক নেতার সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড ইতিবাচক বলা হলেও নেতিবাচক কর্মকাণ্ডের ঘরে অপকর্মের সারসংক্ষেপ উল্লেখ করা হয়েছে।
প্রাপ্ত তথ্য মতে, রাজধানী থেকে শুরু করে ইউনিয়ন পর্যন্ত আওয়ামী লীগের সব পর্যায়ের জনপ্রতিনিধিদের একটি আমলনামা তৈরি করা হয়েছে। যাতে প্রত্যেকের সব ধরনের কর্মকাণ্ডের বিস্তারিত বিবরণ একটি নির্দিষ্ট ফরমেটে উল্লেখ করা হয়েছে। সেখানে ঢাকার একজন ওয়ার্ড কাউন্সিলরের ছাত্রলীগ ব্যাকগ্রাউন্ড তুলে ধরে নেতিবাচক কর্মকাণ্ডের স্থলে ফুটপাতে চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, ক্যাডারবাজি, ভূমি দখলসহ বিভিন্ন অপকর্মে জড়িত বলে উল্লেখ করা হয়েছে। মন্তব্যের ঘরে বলা হয়েছে, চাঁদাবাজি ও অবৈধ উপায়ে শত শত কোটি টাকা আয় করায় সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে।
বিভাগভিত্তিক এই তালিকার মধ্যে টাঙ্গাইল জেলা আওয়ামী লীগের একজন প্রভাবশালী নেতা ছাত্রজীবনে রাজনীতিতে সম্পৃক্ত না থাকলেও জার্মানি থেকে দেশে ফিরে টাকার বিনিময়ে পদ পদবি পেয়েছেন বলে উল্লেখ করা হয়েছে। তার নেতিবাচক কর্মকাণ্ডের স্থলে বলা হয়েছে, জেলায় টেন্ডারবাজি, মানিলন্ডারিং, বাস ও ট্রাক সিন্ডিকেটে চাঁদাবাজি, ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটে চাঁদাবাজি, নিয়োগ বাণিজ্য, অফিস আদালতে প্রভাব বিস্তারসহ ৮ ব্যক্তির সিন্ডিকেটে তিনি অন্যতম। এই জেলার একজন শীর্ষ নেতার ব্যাপারে বলা হয়েছে, তার ছেলে ঠিকাদারি কাজের নিয়ন্ত্রক। আগে তিনি একজন সংখ্যালঘুর ব্যবসা প্রতিষ্ঠান দখল করেছেন।
ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশনের একজন শীর্ষ নেতা সম্পর্কে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ছাত্রজীবনে তিনি কোনো সংগঠনে জড়িত ছিলেন না। অতীতে রাজনীতিতে জড়িত ছিলেন না। সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডের চেয়ে ব্যবসায় ব্যস্ত থাকেন বেশি। লিটন নামে একজন তার হয়ে টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করেন। তার ভাতিজা মাদক ব্যবসায় জড়িত বলেও গোয়েন্দারা উল্লেখ করেছে প্রতিবেদনে। ওই ব্যক্তির বড়ভাই দলীয় কোন্দলে জড়িত। ফরিদপুরের একজন সংসদ সদস্য ও সাবেক মন্ত্রীর বিষয়ে বলা হয়েছে, তিনি আলোচিত বরকত-রুবেলের পৃষ্ঠপোষক এবং তাদের বিএনপি থেকে আওয়ামী লীগে ঢুকিয়েছেন। জামালপুর জেলার এক নেতার সম্পদের মধ্যে ঢাকার লালমাটিয়া ও মনিপুরী পাড়ায় চারটি ফ্ল্যাটের কথাও উল্লেখ করা হয়েছে
নারায়ণগঞ্জ সদর ও রূপগঞ্জে কয়েকজনের অনুপ্রবেশের ব্যাপারে বিস্তারিত উল্লেখ করে তাদের অনেকে নাশকতায় জড়িত ছিলেন এবং সংখ্যালঘু নির্যাতন ও তাদের বাড়িতে অগ্নিসংযোগে জড়িত ছিলেন- এমন তথ্য উঠে এসেছে। এর মধ্যে একজন হাউজিং ব্যবসায়ীর বিএনপি থেকে আওয়ামী লীগে যোগদান এবং কৃতকর্মের তিন পাতার বিবরণ রয়েছে।
মানিকগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের এক শীর্ষ নেতার ব্যাপারে বলা হয়েছে, ১০-১৫ বছর আগেও তার অর্থনৈতিক অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয় ছিল। তিনি চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, বালুমহাল, জমি ও বাড়ি দখল, মাদক ও
পরিবহন ব্যবসায় জড়িত। তার সম্পদের মধ্যে মানিকগঞ্জের বিভিন্ন স্থানে একাধিক বাড়ি, মালয়েশিয়ায় বাড়ি এবং নরেন্দ্র মন্ডল নামে এক সংখ্যালঘুর জমি দখল করে নেয়ার কথা উল্লেখ আছে প্রতিবেদনে। মানিকগঞ্জ সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের একজন নেতার বিরুদ্ধে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর দোহাই দিয়ে টেন্ডারবাজি, বালুমহাল দখল ও পরিবহনে চাঁদাবাজির তথ্য রয়েছে। মানিকগঞ্জ সদর উপজেলার আরেক নেতা, পৌর আওয়ামী লীগ এবং যুবলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের তিন নেতার বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, জমি দখলের কথা বলা হয়েছে ওই গোপন প্রতিবেদনে।
মাদারীপুর জেলার বিভিন্ন পর্যায়ের অনুপ্রবেশকারীদের মধ্যে জাসদ এবং বিএনপি থেকে আওয়ামী লীগের ঢুকে কেন্দ্রীয় দুইজন প্রভাবশালী নেতার ছত্রছায়ায় বিচরণের তথ্য রয়েছে। ওই জেলার একজন এমপির দুই ভাইয়ের ব্যাপারে বিস্তারিত বিবরণে মাদক ব্যবসায় যোগসাজেশ এবং আরেক ভাই উপজেলা নির্বাচনে তার ইন্ধনে দলীয় প্রার্থীর বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্ধিতা করেন বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
রাজবাড়ী জেলায় আওয়ামী লীগ-যুবলীগের ৬ নেতার যৌনপল্লী, লঞ্চ ও ফেরিঘাটে চাঁদাবাজি এবং জেলার একজন শীর্ষ নেতার পৃষ্ঠপোষকতায় তাদের তৎপরতার তথ্য উঠে এসেছে। মাদারীপুর পৌর আওয়ামী লীগের এক নেতার ঢাকার জাপান গার্ডেন সিটিতে কোটি টাকা মূল্যের ফ্ল্যাট রয়েছে উল্লেখ করে অপকর্মের ফিরিস্তি তুলে ধরে বলা হয়েছে, তার অন্য চার ভাই জামায়াত ও বিএনপির রাজনীতিতে সক্রিয়। ওই নেতা কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের একজন যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের ঘনিষ্ঠ বলেও উল্লেখ করা হয়েছে প্রতিবেদনে। শেরপুরের একজন সংসদ সদস্যের বিপুল সম্পদের বিবরণ তুলে ধরে বলা হয়েছে, তার স্ত্রী শিক্ষক নিয়োগ ও বদলি বাণিজ্যে সরাসরি জড়িত। দুর্নীতি দমন কমিশন ওই এমপির পরিবারের সদস্যদের সম্পদের ব্যাপারে অনুসন্ধান করছে বলে গোয়েন্দা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
রাজধানীর একজন সংসদ সদস্য্যের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে বলা হয়েছে, তিনি জাতীয় পার্টি থেকে ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগে যোগ দেন। তার ভাগিনা হত্যা মামলার আসামি এবং তিনি ২০১৯ সালের সিটি করপোরেশন নির্বাচনে দল সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থীর বিরোধীতা করেছেন।
ঢাকা জেলার সাভার উপজেলা অংশে একজন ইউপি চেয়ারম্যানের ছাত্রদল থেকে অনুপ্রবেশ করে ঝুট ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ, সরকারি ও বেসরকারি জমি দখল, একজন সাবেক ওয়ার্ড কাউন্সিলরের তৎপরতা এবং একজন সাবেক ছাত্রদল নেতার মাদকসেবন, ব্যবসা, চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের বিবরণ উল্লেখ রয়েছে। যাতে বলা হয়েছে, তাদের সবার পৃষ্ঠপোষক একজনই।
সূত্র মতে, মহানগর ও সাংগঠনিক জেলা-উপজেলা-পৌরসভার তৃণমূল পর্যন্ত সব পর্যায়ের প্রতিনিধিদের তথ্য গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী হাতে পেয়েছেন। প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণ করে সাংগঠনিক ও আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার কাজ চলছে বলে জানা গেছে।