বাণিজ্যিক দিক দিয়েও এগিয়ে যাচ্ছে দেশ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ‘বাংলাদেশের ৫০ বছরের জাতীয় হিসাব পরিসংখ্যান’ শীর্ষক এক খসড়া প্রতিবেদনে প্রকাশ, জিডিপি (মোট দেশজ উৎপাদন) বেড়েছে চলতি মূল্যে ৬২০ গুণ। অর্থাৎ দেশ স্বাধীনের পর ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরে দেশের জিডিপির আকার ছিল ৬৪.০৯ বিলিয়ন টাকা। ২০২১-২২ অর্থবছরে সেটি বেড়ে হয়েছে ৩৯ হাজার ৭৬৪.৬২ বিলিয়ন টাকা। তুলনামূলক হিসাব করলে এটি ৬২০ গুণ বেশি হয়। সেই সঙ্গে রূপান্তর ঘটেছে অর্থনীতিরও। পরিবর্তন হয়েছে দেশের কৃষিনির্ভরতার। এখন অর্থনৈতিক কাঠামোগত রূপান্তরের পাশাপাশি দেশের অর্থনীতি হয়েছে শিল্পনির্ভর। বৃহৎ তিনটি খাতের মধ্যে জিডিপিতে (স্থূল দেশজ উৎপাদন) কৃষি খাতের অবদান কমেছে। এ ক্ষেত্রে মোট জিডিপিতে ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরে কৃষির অবদান ছিল ৪৩.০৫ শতাংশ। কিন্তু ২০২১-২২ অর্থবছরে সেটি কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ১১.৫ শতাংশে। ফলে মোট জিডিপিতে কৃষির অবদান কমেছে এবং সামগ্রিকভাবে বেড়েছে শিল্প খাতের অবদান।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, রাষ্ট্রপতি হওয়ার সাংবিধানিক বিধান লঙ্ঘন করে জিয়া নিজেকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করেছেন, রাষ্ট্রের স্থপতি ও জাতির জনকের হত্যাকারীদের বিচার করা যাবে না—এমন মানবতাবিরোধী-বর্বর আইন সংবিধানে সংযোজন করেছেন, সংবিধান সংশোধনের বিধানকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে সামরিক ফরমানবলে সংবিধান সংশোধন করে সংবিধানকে দুমড়েমুচড়ে দিয়েছেন। পাকিস্তানের ২৪ বছরের জুলুম-নির্যাতন আড়াল করতে সংবিধানে ‘ঐতিহাসিক সংগ্রাম’-এর পরিবর্তে ‘ঐতিহাসিক যুদ্ধ’ সংযোজন করেছেন। সাংবিধানিকভাবে নিষিদ্ধ ধর্মের অপব্যবহারের রাজনীতি সংবিধান সংশোধন করে জিয়া চালু করেছেন। দালাল আইনে অভিযুক্ত হলে ভোটার হওয়ার অযোগ্যতাকে সংবিধান থেকে বাদ দিয়েছেন। মৃত ব্যক্তির নামে রাজনীতি করা যাবে না—এমন আদেশ জারি করে বঙ্গবন্ধুকে নিষিদ্ধ করেছেন। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের জন্য সংবিধানে বর্ণিত পদ্ধতির বদলে ‘হ্যাঁ, না’ ভোটের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের অদ্ভুত নির্বাচনী বিধান চালু করেছেন। সশস্ত্র বাহিনীর শত শত সদস্যকে প্রহসনের বিচারে ফাঁসিতে ঝুলিয়েছেন।
মুক্তিযুদ্ধের জন্য এ দেশের মানুষ কিভাবে প্রস্তুত হয়েছে, কে প্রস্তুত করেছেন, কত দিন লেগেছে যুদ্ধের পর্যায়ে আসতে? স্বাধীনতাযুদ্ধ চলাকালে সাংবাদিক সিরিলডন টাইম ম্যাগাজিনে লিখেছিলেন, ‘মাতৃভূমিকে পশ্চিম পাকিস্তানের একটি উপনিবেশ থেকে স্বাধীনতার জন্য বর্তমানের চমকপ্রদ নাটকীয় যুদ্ধের পর্যায়ে নিয়ে আসার ঘটনা শেখ মুজিবের এক দিনের ইতিহাস নয়, ২০ বছরেরও বেশি সময় ধরে এটি তাঁর লক্ষ্য ছিল।’
প্রকৃত সত্য হলো, বঙ্গবন্ধু ধাপে ধাপে জাতিকে প্রস্তুত করেছেন মুক্তিযুদ্ধের জন্য। পাকিস্তান সৃষ্টির আগেই বাংলাদেশের স্বাধীনতার কথা ভেবেছেন বঙ্গবন্ধু। ইংরেজদের তাড়িয়ে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের সময় থেকেই বঙ্গবন্ধু স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন। ১৯৭২ সালের ১৮ মার্চ সংবাদ পত্রিকায় কমরেড মণি সিংহের বরাত দিয়ে প্রকাশিত হয়, বঙ্গবন্ধু ১৯৫১ সালে কারাগারে থাকাকালেই বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরিকল্পনা নিয়েছিলেন। চিঠিপত্র আদান-প্রদানের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর এই পরিকল্পনার কথা জানতে পেরেছিলেন বলে মণি সিংহ উল্লেখ করেন। মণি সিংহ আরো বলেছেন, যদিও তাঁদের মধ্যে মতপার্থক্য ছিল, তথাপি বঙ্গবন্ধু তাঁর কাছে এটা জানতে চেয়ে প্রতিনিধি পাঠিয়েছিলেন যে স্বাধীনতাসংগ্রামকে তিনি (মণি সিংহ) সমর্থন করবেন কি না। ভারতের সাবেক হাইকমিশনার শশাঙ্ক এস ব্যানার্জি তাঁর বই ‘India, Mujibur Rahman, Bangladesh Liberation & Pakistan’-এ লিখেছেন, বঙ্গবন্ধু ১৯৬২ সালের ২৪ ডিসেম্বর গভীর রাতে মানিক মিয়াকে সঙ্গে নিয়ে ভারতীয় উপহাইকমিশনে তাঁর সঙ্গে দেখা করেন এবং প্রধানমন্ত্রী জওয়াহেরলাল নেহরুকে লেখা চিঠি হস্তান্তর করে বলেছিলেন, ‘আমি ভারতের কাছে সমমর্যাদার বন্ধুত্বের দাবি নিয়ে স্বাধীনতার প্রশ্নে সমর্থন চাইছি।’
স্বাধীন বাংলাদেশের আন্দোলনকে মুক্তিযুদ্ধের পর্যায়ে নিয়ে যেতে বঙ্গবন্ধু ভাষা আন্দোলনকে বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে রূপ দিয়েছেন। এরপর জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলনে রূপ দিয়েছেন। স্বায়ত্তশাসনকে স্বাধীনতার আন্দোলনে রূপ দিয়ে অর্জন করেছেন স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ। স্বাধীন বাংলাদেশ সৃষ্টিতে অনেক মাইলফলক রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, চুয়ান্নর যুক্তফ্রন্ট, বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন, ছেষট্টির ছয় দফা আন্দোলন, ১৯৬৮ সালের আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থান, ১৯৭০ সালের নির্বাচন, বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ, ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা, ১০ এপ্রিল স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র তথা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালীন সংবিধান প্রণয়ন, ১৭ এপ্রিল মুজিবনগর সরকারের শপথগ্রহণ, ৯ মাসব্যাপী সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ এবং ১৬ ডিসেম্বর চূড়ান্ত বিজয় অর্জন।
কাজেই ‘টেক ব্যাক’ বাংলাদেশ মানে হলো, দেশকে আবার আলো থেকে অন্ধকারে নেওয়ার অপচেষ্টা। আর ‘বাই চান্স’ স্বাধীনতা অর্জনের নতুন তত্ত্ব হলো, মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশকে অস্বীকার করা ও বাংলাদেশকে নিয়ে ভয়ংকর এক ষড়যন্ত্রের ইঙ্গিত।