Home » বিএনপির ‘টেক ব্যাক’ বাংলাদেশ ও ‘বাই চান্স’ স্বাধীনতার রাজনীতি

বিএনপির ‘টেক ব্যাক’ বাংলাদেশ ও ‘বাই চান্স’ স্বাধীনতার রাজনীতি

0 মন্তব্য 117 ভিউজ
বিএনপির প্রবাসী নেতা তারেক রহমান বক্তৃতা-বিবৃতিতে প্রায়ই বলছেন, টেক ব্যাক বাংলাদেশ। প্রশ্ন হলো, কার কাছ থেকে বাংলাদেশ ফেরত চান? কোন বাংলাদেশ ফেরত চান? কেন ফেরত চান? কিভাবে ফেরত চান? পাকিস্তানি হানাদার ও তাদের দোসরদের চূড়ান্তভাবে পরাজিত করে ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর বিজয় অর্জিত হয়। বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি দেশে এসে ১১ জানুয়ারি রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। সেই হিসেবে বঙ্গবন্ধু তিন বছর সাত মাস তিন দিন সশরীরে শাসন করেছেন। এরপর বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতাসহ ১৭ জনকে হত্যা করার মাধ্যমে নামে-বেনামে জিয়ার শাসন শুরু হয়। ১৯৮১ সালের ৩০ মে সামরিক অভ্যুত্থানে জিয়া নিহত হওয়ার পর স্বল্প সময়ের জন্য বিচারপতি সাত্তারের শাসনের পর শুরু হয় হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের শাসন। ১৯৯১ সালে এরশাদ ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর বিচারপতি সাহাবুদ্দীনের কিছুকাল শাসনের পর শুরু হয় খালেদা জিয়ার শাসন। এরপর ১৯৯৬ সালে দীর্ঘ ২১ বছর পর বঙ্গবন্ধুকন্যার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের মাধ্যমে। ২০০১ সালে বিএনপি আবার ক্ষমতায় আসে। ২০০৭ সালে সামরিক বাহিনী সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার দুই বছর দেশ পরিচালনা করার পর ২০০৯ সালে বঙ্গবন্ধুকন্যার নেতৃত্বে সরকার গঠন করে মহাজোট সরকার। সেই থেকে পর পর তিন মেয়াদে আওয়ামী লীগ এবং তাদের জোট শরিকরা সরকার পরিচালনা করছে। তিন মেয়াদে রাষ্ট্রের অভূতপূর্ব পরিবর্তন হয়েছে। অবকাঠামো ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন, পদ্মা সেতু, নদীর তলদেশে টানেল, মেট্রো রেল, স্যাটেলাইটসহ নানা মেগাপ্রজেক্ট বাস্তবায়ন করে বিশ্বকে চমকে দিয়েছে বাংলাদেশ। জলে-স্থলে-অন্তরীক্ষে এক সমীহের নাম বাংলাদেশ। মানবতাবিরোধী অপরাধের প্রধান হোতাদের বিচার শেষে দণ্ড কার্যকর হয়েছে। অন্যদের বিচার চলছে। বঙ্গবন্ধু হত্যা ও জেল হত্যার বিচার হয়েছে। ব্যাংক ব্যবস্থাপনা, দুর্নীতি, অর্থপাচারসহ বেশ কিছু ক্ষেত্রে সরকারের দুর্বলতা ও সমালোচনা রয়েছে। তা সত্ত্বেও কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ আর্থ-সামাজিক সূচকে বাংলাদেশ অনেক এগিয়েছে। শিক্ষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি, ক্রীড়াসহ অনেক ক্ষেত্রে অভাবনীয় অগ্রগতি ঘটেছে। আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে, বিশেষ করে অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নে বাংলাদেশ বিশ্বের কাছে রোল মডেল হিসেবে বিবেচিত।

বাণিজ্যিক দিক দিয়েও এগিয়ে যাচ্ছে দেশ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ‘বাংলাদেশের ৫০ বছরের জাতীয় হিসাব পরিসংখ্যান’ শীর্ষক এক খসড়া প্রতিবেদনে প্রকাশ, জিডিপি (মোট দেশজ উৎপাদন) বেড়েছে চলতি মূল্যে ৬২০ গুণ। অর্থাৎ দেশ স্বাধীনের পর ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরে দেশের জিডিপির আকার ছিল ৬৪.০৯ বিলিয়ন টাকা। ২০২১-২২ অর্থবছরে সেটি বেড়ে হয়েছে ৩৯ হাজার ৭৬৪.৬২ বিলিয়ন টাকা। তুলনামূলক হিসাব করলে এটি ৬২০ গুণ বেশি হয়। সেই সঙ্গে রূপান্তর ঘটেছে অর্থনীতিরও। পরিবর্তন হয়েছে দেশের কৃষিনির্ভরতার। এখন অর্থনৈতিক কাঠামোগত রূপান্তরের পাশাপাশি দেশের অর্থনীতি হয়েছে শিল্পনির্ভর। বৃহৎ তিনটি খাতের মধ্যে জিডিপিতে (স্থূল দেশজ উৎপাদন) কৃষি খাতের অবদান কমেছে। এ ক্ষেত্রে মোট জিডিপিতে ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরে কৃষির অবদান ছিল ৪৩.০৫ শতাংশ। কিন্তু ২০২১-২২ অর্থবছরে সেটি কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ১১.৫ শতাংশে। ফলে মোট জিডিপিতে কৃষির অবদান কমেছে এবং সামগ্রিকভাবে বেড়েছে শিল্প খাতের অবদান।

বৈশ্বিক কারণে অগ্রযাত্রার গতি কিছুটা স্তিমিত হলেও উন্নয়নের পথেই তো রয়েছে দেশ। তার পরও কেন বিদ্বেষ উগরে দিয়ে বলা হচ্ছে ‘টেক ব্যাক বাংলাদেশ’। কেন নয় মুভ ফরোয়ার্ড বাংলাদেশ? তাহলে কোন বাংলাদেশে ফেরত যেতে চায় বিএনপি? নিশ্চয়ই বঙ্গবন্ধু কিংবা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের শাসনে নয়। আর বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার শাসনের বিরুদ্ধেই তো ‘টেক ব্যাক বিদ্বেষ’। তার মানে জিয়া কিংবা খালেদা জিয়া কিংবা উভয় শাসনামলে ফেরত যেতে চান তারেক রহমান। যে গণতন্ত্র, মানবাধিকারের দোহাই দিয়ে বিএনপি বাংলাদেশ ফেরত চান, সেই বিষয়ে মাইকেল কুগেলম্যান বলেন, ‘আমি মনে করি, এটি মনে রাখা উচিত যে ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার আগে বর্তমানে বিরোধী দল বিএনপি যখন ক্ষমতায় ছিল, তখন একই ধরনের কৌশল নিয়েছিল। তখনো দমন-পীড়ন, গুম ছিল। আজ যা যা ঘটছে তার অনেক কিছুই বিএনপি ক্ষমতায় থাকার সময়ও ঘটেছে। আমি মনে করি, এটি স্মরণ রাখা গুরুত্বপূর্ণ।’

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, রাষ্ট্রপতি হওয়ার সাংবিধানিক বিধান লঙ্ঘন করে জিয়া নিজেকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করেছেন, রাষ্ট্রের স্থপতি ও জাতির জনকের হত্যাকারীদের বিচার করা যাবে না—এমন মানবতাবিরোধী-বর্বর আইন সংবিধানে সংযোজন করেছেন, সংবিধান সংশোধনের বিধানকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে সামরিক ফরমানবলে সংবিধান সংশোধন করে সংবিধানকে দুমড়েমুচড়ে দিয়েছেন। পাকিস্তানের ২৪ বছরের জুলুম-নির্যাতন আড়াল করতে সংবিধানে ‘ঐতিহাসিক সংগ্রাম’-এর পরিবর্তে ‘ঐতিহাসিক যুদ্ধ’ সংযোজন করেছেন। সাংবিধানিকভাবে নিষিদ্ধ ধর্মের অপব্যবহারের রাজনীতি সংবিধান সংশোধন করে জিয়া চালু করেছেন। দালাল আইনে অভিযুক্ত হলে ভোটার হওয়ার অযোগ্যতাকে সংবিধান থেকে বাদ দিয়েছেন। মৃত ব্যক্তির নামে রাজনীতি করা যাবে না—এমন আদেশ জারি করে বঙ্গবন্ধুকে নিষিদ্ধ করেছেন। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের জন্য সংবিধানে বর্ণিত পদ্ধতির বদলে ‘হ্যাঁ, না’ ভোটের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের অদ্ভুত নির্বাচনী বিধান চালু করেছেন। সশস্ত্র বাহিনীর শত শত সদস্যকে প্রহসনের বিচারে ফাঁসিতে ঝুলিয়েছেন।

দীর্ঘ সংগ্রাম ও রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ শহীদের এবং কয়েক লাখ কন্যা-জায়া-জননীর চরম আত্মত্যাগের বিনিময়ে স্বাধীন হয়েছে বাংলাদেশ। নজিরবিহীন চড়া দামে অর্জিত স্বাধীনতা নিয়ে বিএনপির আরেক নেতা গয়েশ্বর চন্দ্র রায় ভয়ংকর মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেছেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা ‘বাই চান্স’ বা ‘ভাগ্যক্রমে’ হয়েছে। তাই দেশের সংবিধানও অপরিকল্পিত। তিনি বলেছেন, ক্ষমতায় গিয়ে বিএনপি সেই সংবিধান নতুন করে প্রণয়ন করবে। একাত্তরের ২৬ মার্চ কি আকাশ থেকে টুপ করে পড়েছিল? বঙ্গবন্ধু তাঁর রাজনৈতিকজীবনে চার হাজার ৬৮২ দিন কারাভোগ করেছেন। এর মধ্যে স্কুলের ছাত্রাবস্থায় ব্রিটিশ আমলে সাত দিন কারাভোগ করেন। বাকি চার হাজার ৬৭৫ দিন তিনি কারাভোগ করেন পাকিস্তান সরকারের আমলে। জীবনের প্রায় এক-চতুর্থাংশ কারাভোগ কি তবে ‘বাই চান্স’ ছিল! ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় দীর্ঘ সংগ্রাম, আত্মত্যাগ, অসংখ্য মৃত্যু, নিপীড়ন, নির্যাতনের রক্ত পিচ্ছিল পথ বেয়ে এসেছে মুক্তিযুদ্ধের মাহেন্দ্রক্ষণ। বাংলাদেশের স্বাধীনতার বীজ নিহিত ছিল লাহোর প্রস্তাবের মধ্যে। ১৯৪০ সালের ২৩ মার্চ লাহোর প্রস্তাবের মূল বক্তব্য ছিল—“এ সকল অঞ্চলের ভৌগোলিক সীমানা প্রয়োজনমত পরিবর্তন করে ভারতবর্ষের উত্তর-পশ্চিম ও পূর্বাঞ্চলের যে সকল স্থানে মুসলমানেরা সংখ্যাগরিষ্ঠ সেখানে ‘স্বাধীন রাষ্ট্রগুলো’ (Independent States)  প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এ সমস্ত স্বাধীন রাষ্ট্রের অঙ্গরাজ্য হবে সার্বভৌম ও স্বায়ত্তশাসিত।”

মুক্তিযুদ্ধের জন্য এ দেশের মানুষ কিভাবে প্রস্তুত হয়েছে, কে প্রস্তুত করেছেন, কত দিন লেগেছে যুদ্ধের পর্যায়ে আসতে? স্বাধীনতাযুদ্ধ চলাকালে সাংবাদিক সিরিলডন টাইম ম্যাগাজিনে লিখেছিলেন, ‘মাতৃভূমিকে পশ্চিম পাকিস্তানের একটি উপনিবেশ থেকে স্বাধীনতার জন্য বর্তমানের চমকপ্রদ নাটকীয় যুদ্ধের পর্যায়ে নিয়ে আসার ঘটনা শেখ মুজিবের এক দিনের ইতিহাস নয়, ২০ বছরেরও বেশি সময় ধরে এটি তাঁর লক্ষ্য ছিল।’

প্রকৃত সত্য হলো, বঙ্গবন্ধু ধাপে ধাপে জাতিকে প্রস্তুত করেছেন মুক্তিযুদ্ধের জন্য। পাকিস্তান সৃষ্টির আগেই বাংলাদেশের স্বাধীনতার কথা ভেবেছেন বঙ্গবন্ধু। ইংরেজদের তাড়িয়ে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের সময় থেকেই বঙ্গবন্ধু স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন। ১৯৭২ সালের ১৮ মার্চ সংবাদ পত্রিকায় কমরেড মণি সিংহের বরাত দিয়ে প্রকাশিত হয়, বঙ্গবন্ধু ১৯৫১ সালে কারাগারে থাকাকালেই বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরিকল্পনা নিয়েছিলেন। চিঠিপত্র আদান-প্রদানের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর এই পরিকল্পনার কথা জানতে পেরেছিলেন বলে মণি সিংহ উল্লেখ করেন। মণি সিংহ আরো বলেছেন, যদিও তাঁদের মধ্যে মতপার্থক্য ছিল, তথাপি বঙ্গবন্ধু তাঁর কাছে এটা জানতে চেয়ে প্রতিনিধি পাঠিয়েছিলেন যে স্বাধীনতাসংগ্রামকে তিনি (মণি সিংহ) সমর্থন করবেন কি না। ভারতের সাবেক হাইকমিশনার শশাঙ্ক এস ব্যানার্জি তাঁর বই ‘India, Mujibur Rahman, Bangladesh Liberation & Pakistan’-এ লিখেছেন, বঙ্গবন্ধু ১৯৬২ সালের ২৪ ডিসেম্বর গভীর রাতে মানিক মিয়াকে সঙ্গে নিয়ে ভারতীয় উপহাইকমিশনে তাঁর সঙ্গে দেখা করেন এবং প্রধানমন্ত্রী জওয়াহেরলাল নেহরুকে লেখা চিঠি হস্তান্তর করে বলেছিলেন, ‘আমি ভারতের কাছে সমমর্যাদার বন্ধুত্বের দাবি নিয়ে স্বাধীনতার প্রশ্নে সমর্থন চাইছি।’

স্বাধীন বাংলাদেশের আন্দোলনকে মুক্তিযুদ্ধের পর্যায়ে নিয়ে যেতে বঙ্গবন্ধু ভাষা আন্দোলনকে বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে রূপ দিয়েছেন। এরপর জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলনে রূপ দিয়েছেন। স্বায়ত্তশাসনকে স্বাধীনতার আন্দোলনে রূপ দিয়ে অর্জন করেছেন স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ। স্বাধীন বাংলাদেশ সৃষ্টিতে অনেক মাইলফলক রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, চুয়ান্নর যুক্তফ্রন্ট, বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন, ছেষট্টির ছয় দফা আন্দোলন, ১৯৬৮ সালের আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থান, ১৯৭০ সালের নির্বাচন, বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ, ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা, ১০ এপ্রিল স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র তথা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালীন সংবিধান প্রণয়ন, ১৭ এপ্রিল মুজিবনগর সরকারের শপথগ্রহণ, ৯ মাসব্যাপী সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ এবং ১৬ ডিসেম্বর চূড়ান্ত বিজয় অর্জন।

কাজেই ‘টেক ব্যাক’ বাংলাদেশ মানে হলো, দেশকে আবার আলো থেকে অন্ধকারে নেওয়ার অপচেষ্টা। আর ‘বাই চান্স’ স্বাধীনতা অর্জনের নতুন তত্ত্ব হলো, মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশকে অস্বীকার করা ও বাংলাদেশকে নিয়ে ভয়ংকর এক ষড়যন্ত্রের ইঙ্গিত।

আরও পড়ুন

মতামত দিন

আমাদের সম্পর্কে

We’re a media company. We promise to tell you what’s new in the parts of modern life that matter. Lorem ipsum dolor sit amet, consectetur adipiscing elit. Ut elit tellus, luctus nec ullamcorper mattis, pulvinar dapibus leo. Sed consequat, leo eget bibendum Aa, augue velit.