১৯৬০-এর দশকের শুরুতে তখনকার পূর্ব পাকিস্তান ও দক্ষিণ কোরিয়ার মাথাপিছু আয় ছিল প্রায় সমান। সে সময় তিন প্রথিতযশা মার্কিন অর্থনীতিবিদ পাকিস্তানের উভয় অঞ্চল সফর করে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনীতিতে অচিরেই ‘মিরাকল’ ঘটবে। ঘটেনি, ঘটেছে দক্ষিণ কোরিয়ার অর্থনীতিতে। ১৯৬০ সালে তাদের বার্ষিক মাথাপিছু আয় ১০০ ডলারের কাছাকাছি পৌঁছলেও বিভিন্ন ধরনের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা কারণে ১৯৬১ সালে তা ৭৪ ডলারে নেমে আসে। সে বছরই ১৬ মে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে সেনা কর্মকর্তা পার্ক চুং-হি দেশটির ক্ষমতা দখল করে নিলেন। প্রথাগতভাবে সেনাশাসকের অবৈধ ক্ষমতা দখলের কারণে নিন্দার ঝড় বয়ে যাওয়ারই কথা। শুরুতে তা বইতে শুরু করলেও পার্ক চুং-হির হাতে দেশটি হতদরিদ্র্র দক্ষিণ কোরিয়া থেকে উঠে এসে পৃথিবীকে তাক লাগানো দ্রুত উন্নয়নশীল একটি দেশের কাতারে উত্তীর্ণ হয়। তারপর সত্যিই পৃথিবীর যেকোনো উন্নত দেশের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নামার মতো দেশ হয়ে উঠল দক্ষিণ কোরিয়া।
অর্থনীতিবিদরা পূর্ব পাকিস্তানের যে অর্থনৈতিক মিরাকল দেখতে পাবেন বলে আশা করেছিলেন, তার চেয়ে অনেক বড় মিরাকল দেখিয়ে দিল পার্ক চু-হির দক্ষিণ কোরিয়া। ২০২২-এর ডিসেম্বরে তাদের মাথাপিছু আয় দাঁড়াল ৩২ হাজার ২৩৬ ডলার। আর অর্থনৈতিক উন্নয়নের বর্তমান হার ধরে রাখতে পারলে ২০৫০ সালে দক্ষিণ কোরিয়াবাসীর মাথাপিছু আয় দাঁড়াবে ১ লাখ ৭ হাজার ৭৫২ ডলার। তৃতীয় বিশ্বের কোনো দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের তুলনামূলক বিচারের জন্য পাশে পাকিস্তানকে দাঁড় করিয়ে দিলে চিত্রটি উজ্জ্বলই মনে হবে। আর যদি দক্ষিণ কোরিয়াকে দাঁড় করিয়ে দেয়া হয় তাহলে লজ্জায় মাথা নিচু করে রাখতে হবে। আমরা সেজন্যেই কোরিয়ার কথা পারতপক্ষে উচ্চারণ করি না।
একনায়কত্বের যত অপবাদ দেয়া হোক না কেন, সত্যটি কেউ অস্বীকার করেন না যে দক্ষিণ কোরিয়ার জন্য তিনি ছিলেন একজন ভিশনারি লিডার। দক্ষিণ কোরিয়ানদের বীরের জাতি আর কোরিয়া সোনার দেশ, এমন দক্ষিণ এশীয় নেতাদের মতো এ ধরনের অর্থহীন প্রলাপে তিনি মেতে থাকেননি। তিনি নিজ জাতির নিন্দা করেই বলেছেন, ‘দেশের বাইরে পৃথিবী কত বদলে গেছে সে খবর না রেখে কোরিয়ানরা এখনো তাদের ঐতিহ্যগত পশ্চাৎপদ জীবন ব্যবস্থাকেই আঁকড়ে ধরে আছে।’ সেনাশাসক বলে গাল দিন, তবু শুনুন তার কথা। তিনি তার দেশবাসীকে বলছেন, ‘যখন আকাশ পরিষ্কার থাকে চলুন চাষাবাদ করি আর যখন বৃষ্টি ঝরছে তখন চলুন পড়াশোনা করি।’
পার্ক বলেছেন, ‘কোরিয়া থেকে দারিদ্র্যের পরিসমাপ্তি ঘটাতে আমাদের যা করণীয় তা অবশ্যই করতে হবে, যাতে এ প্রজন্মের দুর্ভাগ্যজনক অভিজ্ঞতা আগামী প্রজন্মের না হয়। ১৯৬১ সালের মে মাসে রেভল্যুশনারি গ্রুপের নেতা হিসেবে আমি যখন ক্ষমতা গ্রহণ করি, আমি সততার সঙ্গে অনুভব করতাম সম্পদ তছনছ হয়ে যাচ্ছে, এমন একটি বাড়ি কিংবা দেউলিয়া হয়ে যাওয়া একটি প্রতিষ্ঠান ব্যবস্থাপনার জন্য আমাকে দেয়া হয়েছে। আমার চারপাশে আশাব্যঞ্জক কোনো উৎসাহ ছিল না, দেশের বহিরাবরণ বড় বিষণ্ন। কিন্তু আমাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে আমাকে তো হতাশাবাদ কাটিয়ে উঠতে হবে। চিরজনমের মতো দরিদ্র ও অর্থনৈতিক স্থবিরতার দুষ্টচক্র ধ্বংস করতে হবে। একমাত্র অর্থনৈতিক সংস্কারের মাধ্যমে আমাদের মানুষের উন্নত জীবনের একটি ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করতে পারব।’
তিনি যে দূরদৃষ্টি নিয়ে কাজ করেছেন, তিনি একটি পার্কবাদের প্রতিষ্ঠাতা, এ দাবি করতে পারতেন। তার গায়ে লাগা উত্তর কোরিয়ায় তখন চলছে ‘জু চে’ ভাবধারা। সুযোগসন্ধানীরা নেতাদের দুর্বলতা কাজে লাগিয়ে এ ধরনের বাদ প্রচার করে প্রকারান্তরে নেতার ও দেশের ক্ষতিই করে থাকেন।
ষাটের দশকে চার্টার অব ন্যাশনাল এডুকেশন অব কোরিয়া পার্কের কথাই উদ্ধৃত করেছে: আমরা এ মাটিতে জন্মগ্রহণ করেছি, এ জাতির পুনর্জাগরণের মিশন পরিচালনার ঐতিহাসিক দায়িত্ব আমাদের দেয়া হয়েছে।
রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে তিনি ঘায়েল করেছেন কিন্তু তা দেশের স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে নয়।
৩০ সেপ্টেম্বর ১৯১৭ সালে কোরিয়ার শিল্প শহর দায়েগুতে একটি দরিদ্র পরিবারে তার জন্ম। সাত সন্তানের কনিষ্ঠতম। পড়ার নেশা ছিল তার, বিশেষ করে সমর বিজ্ঞান এবং সমর নায়কদের কাহিনী। স্কুলের ধনী শিশুদের হোমওয়ার্ক করে দিয়ে বিনিময়ে তাদের কাছ থেকে স্কুলে খাবার টিফিনটা পেতেন। কোরীয় যুদ্ধে তাদের বাড়িটা বিধ্বস্ত হয়ে যায়। কোরিয়া তখনো জাপানি শাসনাধীনে আসেনি। কিছুকাল শিক্ষকতা করে জুনিয়র লেফটেন্যান্ট হিসেবে জাপানি সেনাবাহিনীতে যোগ দেন এবং উত্তরপূর্ব চীনের জাপান অভিষিক্ত পুতুল সরকারের অধীনে ১৯৩৯-১৯৪৫ পর্যন্ত কর্মরত থাকেন। যখন জাপান কোরিয়া দখল করে নিল, তিনি নিজ দেশে রাজকীয় জাপানের ‘রাজাকার’ হিসেবে চিহ্নিত হলেন।মাঞ্চুরিয়ার জাপানি মিলিটারি একাডেমি থেকে গ্র্যাজুয়েট হন। চার বছর পর একটি কমিউনিস্ট সংগঠনের সঙ্গে যোগসাজশের কারণে তিনি তাদের দলে যোগ দিয়েছেন, এ অভিযোগে গ্রেফতারের পর তার কোর্ট মার্শাল হয় এবং যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন। এক জ্যেষ্ঠ জেনারেলের প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপে যাবজ্জীবন কারাবাস থেকে রেহাই পেলেও তার সামরিক কর্মকর্তার মর্যাদা বাতিল করা হয়। কিন্তু কোরীয় যুদ্ধের সময় সৈন্যের ঘাটতি তাকে পুনরায় যোগদানের সুযোগ করে দেয় এবং তিনি নিষ্ঠাবান ও কৌশলী সৈনিক হিসেবে মেজর জেনারেল পদ পর্যন্ত পদোন্নতি লাভ করেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী চ্যাং মিয়োন স্বাধীনচেতা পার্কের পদাবনতি ঘটান। তার বিরুদ্ধে কমিউনিস্ট উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে গোপন যোগাযোগের একটি অভিযোগ বারবার সামনে এসেছে। এদিকে সেনাবাহিনীর বিভিন্ন ধরনের লুণ্ঠন ও সুবিধা লাভের প্রবণতা যখন যুদ্ধোত্তর কোরীয় বাহিনীতে একটি স্বাভাবিক ব্যাপার বলে মনে করা হচ্ছিল, তখন আগাগোড়া সততার স্বাক্ষর রেখে যাওয়া পার্ক এসবের বিরোধিতা করে অনেক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা ও সহকর্মীর বিরাগভাজন হন। অন্যদিকে, তাকে আন্তরিকভাবে সমর্থন করা একটি তরুণ সেনাদল গঠিত হতে থাকে। মূলত দারিদ্র্য, দুর্নীতির কারণে ক্ষিপ্ত তরুণ সমাজের আন্দোলনে ১৯৬০ সালে চল্লিশের শোক থেকে ক্ষমতাসীন সিংম্যান রি সরকারের পতন ঘটে। ১৯৬১-এর মে মাসে একটি দ্বিতীয় অভ্যুত্থানের মাধ্যমে পার্ক চুং-হি ক্ষমতাসীন হন। অন্তর্বর্তী সরকার টিকে ছিল মাত্র ১০ মাস। পার্ক চুং-হির রক্তপাতবিহীন অভ্যুত্থান দেশের মানুষ স্বাগত জানায়। তারা বিরাজমান শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে চাচ্ছিল। দক্ষিণ কোরিয়ায় অবস্থানরত বিশাল বাহিনী এ ক্ষমতা বদলে সক্রিয় কোনো ভূমিকা পালন করেনি।
পার্ক চুং-হি একটি সামরিক সংবিধান জারি করে ক্ষমতা সংহত করেন। ডেমোক্রেটিক-রিপাবলিকান পার্টি গঠন করেন এবং বিপুল জনসমর্থন নিয়েই এ দলের প্রার্থী হিসেবে ১৯৬৩-এর অক্টোবরে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন।
পার্কের প্রধান ফোকাস ছিল অর্থনৈতিক সংস্কার ও দারিদ্র্যমুক্তি। তিনি কমিউনিস্ট ছিলেন না। তা হলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পাশ্চাত্যের অনেক উন্নত দেশের সমর্থন ও উন্নয়ন সহায়তা পেতেন না। কিন্তু তার ভেতরে একটি সমতাবাদী মন ছিল। তিনি ধনতন্ত্রের বিকাশ ঘটাতে চেয়েছেন। একই সঙ্গে যত দ্রুত সম্ভব নিঃস্ব ও প্রান্তিক চাষী-মজুরদের সম্পদে প্রবেশাধিকারও নিশ্চিত করতে চেয়েছেন। দেশের মানুষের জন্য প্রতিদিন টানা ১৮ ঘণ্টা কাজ করার মিথ প্রত্যক্ষদর্শী সাধারণ মানুষের কাছে বিশ্বাসযোগ্য হয়ে উঠেছিল এবং তারা তাদের অবস্থার পরিবর্তন দেখতে শুরু করেন। ফলে কথিত গণতন্ত্রী ও মানবাধিকার আন্দোলনকারীরা যা-ই বলুন, ষাটের দশকে দক্ষিণ কোরিয়ার জনগণ তাদের প্রত্যাখ্যানই করেছে। সোভিয়েত আদলের হলেও পার্ক চুং-হির প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা বুকশেলফে রাখা কোনো দলিল নয়, তিনি যেভাবে ভেবেছেন, তা বাস্তবায়নও করেছেন:
১. ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছানো; বিদ্যুৎ ও জ্বালানি শক্তিকে অর্থনীতির চালিকাশক্তিতে পরিণত করা, দেশীয় কয়লার সর্বোচ্চ ব্যবহারের মাধ্যমে জ্বালানি উৎপাদন।
২. জাতীয় অর্থনীতির কাঠামোগত ভারসাম্যহীনতা দূর করতে কৃষিপণ্য উৎপাদন বৃদ্ধি ও ব্যক্তি পর্যায়ে খামারের আয় বৃদ্ধি।
৩. অত্যাবশ্যকীয় শিল্প ও অর্থনৈতিক অবকাঠামো প্রতিষ্ঠা।
৪. অলস ও অব্যবহৃত সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, বেকারত্ব লাঘব এবং কৃষিজমির সর্বোচ্চ ব্যবহার।
৫. রফতানি বাড়িয়ে আয়-ব্যয়ের ভারসাম্যের উন্নতি করা।
৬. বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নয়ন এবং সম্ভাব্য ক্ষেত্রে প্রযুক্তির সর্বোচ্চ প্রয়োগ।
এ ধরনের লক্ষ্য বাংলাদেশসহ আরো কোনো কোনো দেশের পরিকল্পনা দলিলের গুণগত মান বৃদ্ধি করতে দেখা গেছে। কিন্তু এসবের বাস্তব প্রয়োগ হয়েছে সামান্যই।
কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে প্রকাশিত টু বিল্ড দ্য নেশনে পার্কের নিজের কথা:
১৬ মে (১৯৬১)-এর আগের কোরীয় অর্থনীতির ছিল লণ্ডভণ্ড দশা। সঞ্চিত রাজনৈতিক অপসিদ্ধান্ত এবং ভ্রান্তপথে পরিচালিত অর্থনৈতিক পরিকল্পনায় যুদ্ধোত্তর কোরিয়ার পুনর্বাসন স্থগিত হয়ে গিয়েছিল। বিদেশী অনুদান ও সহায়তা কমেছে। অর্থনৈতিক বিচলতা দারিদ্র্য ও বেকারত্ব বাড়িয়ে দিয়েছে। ঋণগ্রস্ত কৃষকের তখন মরণদশা…মানুষ নিয়তিবাদী হয়ে দারিদ্র্যকে মেনে নিয়েছে এবং রাষ্ট্রচালকরা ধরে নিয়েছেন বিদেশী আর্থিক সাহায্যই তাদের টিকিয়ে রাখবে। ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিরা নিজেদের ভূমিকা পালন না করে হাত গুটিয়ে নিয়েছে। সরকারি কর্মকর্তা দুর্নীতি ঘুসের অর্থ পাচার করতে শুরু করেছে। বাজার শক্তিহীন ও অকার্যকর হয়ে পড়েছে। সামগ্রিকভাবে অর্থনীতির নিয়ন্ত্রণ চলে গেছে অদক্ষ, অনভিজ্ঞ ও অপচয় করা ব্যবস্থাপকদের হাতে। এ অবস্থা থেকে প্রত্যাবর্তন ছিল একটা বড় চ্যালেঞ্জ।
ডিউক ও জর্জ ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ইন্দর সুদ যখন কোরিয়া সফর করছিলেন, তখন এয়ারপোর্টের কাছে কোরীয় ভাষায় বিলবোর্ডের একটি লেখা দেখে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, কী লেখা আছে। ভাঙা ইংরেজিতে ড্রাইভার যা বলেছে তার মানে: রফতানি করো অথবা মরে যাও, এক্সপোর্ট অর ডাই।
কথাটা তাদের প্রেসিডেন্ট পার্ক চুং-হির। তিনি দিনরাত কাজ করেন এবং কোরিয়াকে একটি রফতানি প্রধান দেশে পরিণত করাই তার লক্ষ্য। রফতানি বাড়াতে এমন আগ্রাসী ভূমিকায় সে সময় আর কাউকে দেখা যায়নি। ‘আবর্জনার ঢিবিতে গোলাপ প্রস্ফুটন’ কথাটা এ ভারতীয় মার্কিন অধ্যাপকের। আবর্জনার ঢিবিকে সুফলা জমিনে রূপান্তরিত করে গোলাপ ফোটানোর মতো কাজটা পার্ক চুং-হি করেছেন।
প্রতিরক্ষা বিভাগকে উপেক্ষা করে নয়, দক্ষিণ কোরিয়াকে উত্তর কোরিয়ার সম্ভাব্য আক্রমণের বিরুদ্ধে একটি সমর প্রস্তুত দেশে সমভাবে উন্নীত করেছেন এবং সাধারণ মানুষের জীবনমানে এক দশকেই স্বপ্নতুল্য পরিবর্তন ঘটিয়েছেন।
পার্ক চুং-হির সরকারের হাতেই ঘটেছে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার স্মরণকালের শ্রেষ্ঠ শিক্ষা সংস্কারকাজ। কাব্য আর কল্পলোকের কাহিনীতে দেশ এগোতে পারে না, দেশ পিছিয়ে যায়। পার্কের শিক্ষা ব্যবস্থার প্রধান ফোকাস বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টিকারী প্রায়োগিক শিক্ষা। বিভাজিত কোরিয়ার শিল্প সমৃদ্ধ অঞ্চল পড়েছে সমাজতান্ত্রিক উত্তর কোরিয়ার ভাগে। ভারী শিল্প ও শক্তিশালী সামরিক ঘাঁটি নিয়ে উত্তর কোরিয়া কতটা এগিয়েছে, পাশাপাশি দক্ষিণ কোরিয়াকে দেখলে তা ম্লান হয়ে যায়। কিম ইল সুংয়ের কাল্ট এবং সমাজতান্ত্রিক ‘জু চে’ ভাবধারা উত্তর কোরিয়াকে স্থবির ও বিচ্ছিন্ন একটি রাষ্ট্রে পরিণত করেছে আর পার্ক চুং হি-র দূরদৃষ্টি দক্ষিণ কোরিয়াকে ধনবাদী কল্যাণকামী রাষ্ট্রগুলোর শীর্ষস্থানে নিয়ে গেছে।
কোরিয়ার স্বনির্ভর সমাজ সৃষ্টির আন্দোলন একটি বৈশ্বিক মডেল। ১৯৬৫ সালে একদল পাশ্চাত্যের সাংবাদিক যান পার্ক চুং-হির সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে। তাদের ধারণা ছিল সামরিক চাকচিক্য এবং কমান্ড দেখিয়ে পার্ক তাদের মুগ্ধ করতে চেষ্টা করবেন। কিন্তু তারা গিয়ে পেলেন দেয়ালে সাঁটা মানচিত্রে অধিকতর দারিদ্র্যপীড়িত অঞ্চলের পরিচয়, পরিসংখ্যান, ডায়াগ্রাম, বাণিজ্যের গতিবিধি, ট্যাক্স কাঠামো, ট্যাক্স আদায়, শিক্ষা পরিকল্পনা। দেয়ালে সাঁটানো আরো কাগজে দেখানো হচ্ছিল নতুন নতুন শিল্প স্থাপনা, সম্ভাব্য উৎপাদন এবং রফতানির সম্ভাবনার আশাবাদী চিত্র। ‘ম্যাগালোমেনিয়াক’ শাসনের ‘বিগ টক’ নয়, তারা পেয়েছেন ভিন্ন এক চিত্র। সেনাশাসন নয়, দারিদ্র্যপীড়িত একটি দেশে রাতারাতি পরিবর্তন ঘটানো একজন নেতার সাক্ষাৎ তারা পেয়েছেন। তাদের মনে হয়েছে এ অনাকর্ষণীয় শারীরিক গঠনের মানুষটিই আধুনিক দক্ষিণ কোরিয়ার স্থপতি হতে যাচ্ছেন।
পার্ক চুং-হি স্বৈরশাসক, একনায়ক, বিরোধী রাজনীতিবিদদের এ ধরনের অভিযোগ আছে কিন্তু পার্ক, দুর্নীতিবাজ, মানি লন্ডারার, স্বজন তোষক, রাষ্ট্রীয় স্বার্থ উপেক্ষাকারী—এ ধরনের অভিযোগ নেই। তিনি গণতন্ত্র বিরোধী এটা মানতে নারাজ হলেও জোর দিয়েই বলেছেন গণতন্ত্র রাতারাতি মন্দ মানুষকে ভালো মানুষে পরিণত করতে পারে না; দুর্নীতিবাজ রাজনীতিকদের শক্তভাবেই মোকাবেলা করতে হয়।
একটি ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণ
২০০২ সালে দক্ষিণ কোরীয় পররাষ্ট্র দপ্তরের আমন্ত্রণে মূলত রিপাবলিক অব কোরিয়া দেখা ও জানার জন্য সে দেশ সফর করি। কিছুটা অনানুষ্ঠানিক সম্পর্কের কারণে তখনকার ঢাকায় নিযুক্ত রাষ্ট্রদূত লিকে জিজ্ঞেস করি, সেখানে গিয়ে পার্ক চুং-হিকে নিয়ে কোনো প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতে বাধা নেই তো? তিনি বললেন, রাজনৈতিক কারণে জোর গলায় না বললেও অন্তরে তার সম্পর্কে দক্ষিণ কোরিয়ার সব সাধারণ মানুষ বিশেষ শ্রদ্ধা পোষণ করেন। তার কারণেই তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ সবার বাড়িতে বিদ্যুৎ পৌঁছেছে। সে সময় সার্সের প্রকোপ ছিল। এয়ারপোর্টে বাড়তি সতর্কতা। এ কর্মসূচিতে অংশগ্রহণকারী পাঁচজন জাপানে নিযুক্তির আদেশাধীন মিসরীয় রাষ্ট্রদূত, তেহরান টাইমস পত্রিকার সম্পাদক, আলজেরীয় সরকারের একজন ঊর্ধ্বতন নারী কর্মকর্তা, পাকিস্তানের একজন হুইপ (ওমর আইয়ুব, সাবেক প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের নাতি, গওহর আইয়ুবের পুত্র) এবং বাংলাদেশ থেকে আমি। দ্বিতীয় দিন আমাদের নিয়ে গেল হুন্দাই গাড়ির কারখানায়। বিস্মিত হয়ে দেখলাম, বিশাল এ কারখানায় যে বিদ্যুৎ খরচ হয়, তা তখনকার সমগ্র বাংলাদেশের মোট চাহিদার চেয়েও কিছুটা বেশি। পরবর্তী সময় জেনেছি, পার্ক চুং-হির শিল্প ও রফতানি সুযোগ সৃষ্টির কারণেই হুন্দাইর মতো মেগা প্রতিষ্ঠান সৃষ্টি হতে পেরেছে।
এর মধ্যে রাষ্ট্রদূত লি (পরবর্তীকালে কোরীয় পররাষ্ট্র দপ্তরের ভাইস মিনিস্টার) কৌশলগত বৈঠকে যোগ দিতে দেশে এলেন। আমাদের একটি ‘অফ ডে’-তে তিনি এসে আমাকে তুলে নিলেন এবং বললেন আমাকে হান নদীর দু’পাড়ে লং ড্রাইভে নিয়ে যাবেন। পার্ক চুং-হির নেতৃত্বে কোরীয় পরিবর্তনকে ‘মিরাকল অব হান’ বলা হয়ে থাকে। রাষ্ট্রদূত লি আমাকে নদীর এক প্রান্তে সারি সারি পরিত্যক্ত বহুতল ভবনের সামনে এনে বললেন, পার্ক চুং-হির অনেক ভালো পরিকল্পনার মধ্যে এটি একটি ভুল পরিকল্পনা। ষাটের দশকে নির্মিত এসব অ্যাপার্টমেন্ট ব্লক গ্রামের বিভিন্ন পরিবারের নামে বরাদ্দ দেয়া এবং তাদের আসতে বাধ্যও করা হয়। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে গ্রামের মানুষের রয়েছে হাঁস, মুরগি আর গরু বাছুর ও শূকর। এগুলোকে কীভাবে অ্যাপার্টমেন্টে তুলবে? তারা দ্রুত বরাদ্দ করা বাড়ি ছেড়ে গ্রামের বাড়িতে ফিরে গেল। পার্ক চুং-হি নজর দিলেন রফতানিমুখী শিল্পের দিকে। অধিক লাভজনক প্রমাণিত হওয়ায় কৃষিশ্রমিক শিল্পশ্রমিক হয়ে গেল, হাঁস-মুরগি, গরু-বাছুর কমতে থাকল। কোনো কোনো পরিবার আবার অ্যাপার্টমেন্টে ফিরে এল। কিন্তু কয়েক বছরের মধ্যে জাতীয় প্রবৃদ্ধি এবং মানুষের আয় এতটাই বেড়ে গেল যে তারা ছোট অ্যাপার্টমেন্ট ছেড়ে স্বাধীনভাবে বাড়িঘর করতে শুরু করল। সে অ্যাপার্টমেন্ট ব্লক আবার পরিত্যক্ত হয়ে গেল। নগর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ সচেতন হয়ে উঠল এবং সীমিত ভূমি সম্পদের উপযুক্ত ব্যবহারের ওপর জোর দিল। ২০০২ সালে আমার দেখা দক্ষিণ কোরিয়া সে সময়ের অন্যতম সমৃদ্ধ দেশগুলোর একটি। তার পর ২১ বছর কেটে গেছে। ‘ইস্ট এশিয়ান ইকোনমিক স্লাম্প’ কোরিয়াকে তেমন স্পর্শ করতে পারেনি। কোরীয় একটি উন্নয়ন ইনস্টিটিউটে বিতর্কে অংশ নিতে হাজির হলাম। বিতর্ক শেষে আমরা এটাই বুঝলাম যে গণতন্ত্র ভালো, কিন্তু বিশেষ বিশেষ দেশ ও রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে চাই পার্ক চুং-হির মতো একনায়ক। আরো দুটি নাম উঠে এল: মালয়েশিয়ার মাহাথির মোহাম্মদ ও সিঙ্গাপুরের লি কুয়ান ইউ।
দক্ষিণ কোরিয়া আমার জন্য একটি স্মরণীয় সফর। দক্ষিণ কোরীয় সরকারের দেয়া দৈনিক ভাতার কিছুটা সাশ্রয় করে সিউলের বইয়ের দোকান থেকে কিনে এনেছি ইংরেজিতে অনূদিত কোরীয় সাহিত্যের বেশ ক’টি গ্রন্থ। কিন্তু কেন যে পার্ক চুং-হিকে নিয়ে লেখা একটি বইও কিনিনি, সেজন্য আফসোস হচ্ছে, তা হলে লেখাটি আরো সমৃদ্ধ হতে পারত।