Home » পারমাণবিক শক্তি ব্যবহারকারী দেশ হতে যাচ্ছে বাংলাদেশ

পারমাণবিক শক্তি ব্যবহারকারী দেশ হতে যাচ্ছে বাংলাদেশ

0 মন্তব্য 51 ভিউজ

রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের মাধ্যমে বিশ্বের ৩৩তম পারমাণবিক শক্তি ব্যবহারকারী দেশ হতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। এই বিদ্যুৎকেন্দ্রে ব্যবহারের জন্য পারমাণবিক জ্বালানি বা ইউরেনিয়াম গত বৃহস্পতিবার বিশেষ উড়োজাহাজে বাংলাদেশে এসে পৌঁছেছে। গতকাল শুক্রবার তা কড়া নিরাপত্তার মধ্য নিয়ে রূপপুরে পৌঁছায়।
আগামী ৫ অক্টোবর রূপপুরে ইউরেনিয়াম আনুষ্ঠানিকভাবে হস্তান্তরে এক অনুষ্ঠান হওয়ার কথা রয়েছে। এটি উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। তাঁরা দুজন অনুষ্ঠানে অনলাইনে যুক্ত হতে পারেন।
আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থার (আইএইএ) মহাপরিচালক রাফায়েল গ্রোসি অনুষ্ঠানে অংশ নিতে বাংলাদেশে আসবেন বলে কথা রয়েছে। তবে তিনি না এসে অনলাইনে অনুষ্ঠানে যুক্ত হতে পারেন বলে জানা গেছে। রূপপুরে উপস্থিত থাকতে পারেন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমন্ত্রী ইয়াফেস ওসমান এবং পারমাণবিক জ্বালানি উৎপাদনকারী রাশিয়ার রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা পারমাণবিক শক্তি করপোরেশনের (রোসাটম) মহাপরিচালক অ্যালেক্সি লিখাচেভ।
যে ইউরেনিয়াম বাংলাদেশে আনা হয়েছে, তা এখনই ব্যবহার করা হবে না, এটি মজুত করে রাখা হবে রূপপুরে। বিদ্যুৎকেন্দ্রটির প্রথম ইউনিট থেকে আগামী বছর জাতীয় গ্রিডে পরীক্ষামূলক বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে চায় রূপপুর কর্তৃপক্ষ। একই বছর বাণিজ্যিকভাবে বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু করার আশা করছে তারা।
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন প্রকল্পের বিভাগীয় প্রধান অলোক চক্রবর্তী জানান, প্রধানমন্ত্রী ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্টের অংশগ্রহণে জ্বালানি হস্তান্তর অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে পরমাণু শক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহারকারী দেশের তালিকায় ৩৩তম দেশ হিসেবে বিশ্ব অঙ্গনে আত্মপ্রকাশ করবে বাংলাদেশ।
ওয়ার্ল্ড নিউক্লিয়ার অ্যাসোসিয়েশনের ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, পারমাণবিক শক্তি ব্যবহারকারী দেশের মধ্যে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ফ্রান্স, রাশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, কানাডা, ইউক্রেন, জার্মানি, জাপান, স্পেন, সুইডেন, বেলজিয়াম, যুক্তরাজ্য, ভারত, চেক প্রজাতন্ত্র, ফিনল্যান্ড, সুইজারল্যান্ড, বুলগেরিয়া, পাকিস্তান, হাঙ্গেরি, স্লোভাকিয়া, ব্রাজিল, দক্ষিণ আফ্রিকা, মেক্সিকো, রোমানিয়া, আর্জেন্টিনা, সংযুক্ত আরব আমিরাত, বেলারুশ, স্লোভেনিয়া, নেদারল্যান্ডস, ইরান ও আর্মেনিয়া।
দেশের সবচেয়ে বড় প্রকল্প
দেশের সবচেয়ে বড় একক প্রকল্প রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। এটি নির্মাণে ব্যয় হচ্ছে ১ হাজার ৩৫০ কোটি মার্কিন ডলার, যা বর্তমান বাজারমূল্যে প্রায় ১ লাখ ৪৮ হাজার ৫০০ কোটি টাকা (প্রতি ডলার ১১০ টাকা ধরে)। মোট ব্যয়ের প্রায় ৮০ শতাংশ অর্থ রাশিয়া ঋণ হিসেবে দিচ্ছে।
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন পরমাণু শক্তি কমিশন। এ প্রকল্পের আওতায় ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াটের দুটি ইউনিট নির্মাণ করছে রাশিয়ার ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান অ্যাটমস্ট্রয়এক্সপোর্ট। পারমাণবিক জ্বালানি উৎপাদন করছে রোসাটমের সহযোগী প্রতিষ্ঠান টিভিইএল ফুয়েল কোম্পানি। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ তাদের থেকে পারমাণবিক জ্বালানি কেনে।
আইএইএর একাধিক প্রতিনিধিদল বাংলাদেশে এসে পারমাণবিক জ্বালানি গ্রহণের সক্ষমতা নিয়ে ইতিবাচক মূল্যায়ন দিয়েছে। তার আগেই আইএইএ থেকে সব ধরনের সনদ নেওয়া হয়েছে।
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রথম উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল ১৯৬১ সালে। এরপর নানা সময়ে প্রকল্পের প্রস্তুতিমূলক কিছু কিছু কাজ হয়েছে। ২০১৩ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রাশিয়া সফরে দেশটির সঙ্গে রূপপুর প্রকল্পের ঋণ চুক্তি সই হয়। একই বছর রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন (১ম পর্যায়) প্রকল্প নেওয়া হয়। কাজের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হয় ২০১৩ সালের ২ অক্টোবর। বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মিত হচ্ছে পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলার পাকশী ইউনিয়নের রূপপুর গ্রামে।
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাজ এখন অনেকটা শেষের দিকে। দুটি ইউনিটের মধ্যে প্রথমটি বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য প্রস্তুত হয়ে গেছে।
এর আগে গত বছর নভেম্বরে রূপপুরের যন্ত্রাংশ বহনকারী একটি রাশিয়ার জাহাজ বাংলাদেশে আসা নিয়ে সংকট তৈরি হয়েছিল। উরসা মেজর নামের জাহাজটি ছিল যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার আওতাধীন। নাম পরিবর্তন করে সেটি রূপপুরের পণ্য নিয়ে বাংলাদেশে আসছিল। তবে বাংলাদেশ জাহাজটিকে ভিড়তে দেয়নি। পাশাপাশি পশ্চিমারা রাশিয়ার কয়েকটি ব্যাংকের ওপরে নিষেধাজ্ঞা দেওয়ায় রূপপুরের ঋণের কিস্তি পরিশোধ নিয়েও জটিলতা তৈরি হয়েছে। কী উপায়ে, কোন মুদ্রায় ঋণের কিস্তি পরিশোধ হবে, তা এখন চূড়ান্ত হয়নি।
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র কর্তৃপক্ষের সূত্র বলছে, বিদ্যুৎকেন্দ্রের চুল্লিপাত্রে একবার পারমাণবিক জ্বালানি মজুত করা হলে তা দিয়ে এক বছর বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যাবে। এরপর আবার নতুন করে চুল্লিপাত্রে জ্বালানি মজুত করতে হবে।
ইউরেনিয়াম দেশে
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় এবং রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্প সূত্র বলছে, গত বৃহস্পতিবার দুপুরে একটি বিশেষ উড়োজাহাজে রাশিয়া থেকে ইউরেনিয়ামের প্রথম চালান ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছায়। শুক্রবার সকালে বিশেষ নিরাপত্তাবলয়ে ইউরেনিয়াম বহনকারী যানবাহনের বহর রূপপুরের উদ্দেশে রওনা দেয়। বহরটি গাজীপুর, টাঙ্গাইল, বঙ্গবন্ধু সেতু হয়ে সিরাজগঞ্জ অতিক্রমের পর বনপাড়া-হাটিকুমরুল সড়ক দিয়ে রূপপুরে যায়। এ সময় সড়কে যানচলাচল বন্ধ রাখা হয়েছিল।
ইউরেনিয়াম বহনকারী যানবাহনের বহরটি শুক্রবার বেলা ১টা ১৮ মিনিটে রূপপুর প্রকল্প এলাকায় পৌঁছায়। এ সময় প্রকল্পে কর্মরত রাশিয়ার নাগরিকেরাসহ কর্মীরা উল্লাস প্রকাশ করেন। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক শৌকত আকবর সাংবাদিকদের বলেন, ইউরেনিয়াম আসার মধ্য দিয়ে প্রকল্পটি পারমাণবিক স্থাপনায় উন্নীত হলো।
রূপপুর কর্তৃপক্ষ বলছে, চুক্তি অনুসারে জ্বালানি বিমানবন্দরে নামার পর নিরাপত্তার দায়িত্ব ছিল বাংলাদেশের। ইউরেনিয়ামের মালিকানাও বাংলাদেশের। ইউরেনিয়াম পরিবহনে দুর্ঘটনার নজির নেই। তাই উচ্চ ব্যয় এড়াতে দেশের মধ্যে পরিবহনের জন্য কোনো বিমা করা হয়নি। সভরেন গ্যারান্টি বা রাষ্ট্রীয় নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছিল।
ইউরেনিয়াম অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ একটি ধাতু। আমদানি, পরিবহন ও সংরক্ষণের জন্য আইএইএর অনুমোদন ও রাশিয়ান ফেডারেশনের রপ্তানি নীতি বজায় রাখতে হয়েছে। পারমাণবিক জ্বালানি উৎপাদন প্রস্তুতিসংক্রান্ত সনদ চূড়ান্ত করতে গত ৪ মে দুই দেশের প্রতিনিধিদলের বৈঠকে প্রস্তুতি সনদ সই হয়। এরপর রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য পারমাণবিক জ্বালানি উৎপাদন শুরু করে রাশিয়া। গত মাসে প্রথম দফার জ্বালানি উৎপাদন শেষ হয়।
ইউরেনিয়াম বাংলাদেশে আসার মাধ্যমে রূপপুর প্রকল্পের একটি মাইলফলক অর্জিত হলো। তবে শিগগিরই বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে, বিষয়টি তা নয়। নানা রকম পরীক্ষা ও প্রস্তুতির পর বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিউক্লিয়ার ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক শফিকুল ইসলাম
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন প্রকল্পের বিভাগীয় প্রধান অলোক চক্রবর্তী প্রথম আলোকে বলেন, আইএইএর একাধিক প্রতিনিধিদল বাংলাদেশে এসে পারমাণবিক জ্বালানি গ্রহণের সক্ষমতা নিয়ে ইতিবাচক মূল্যায়ন দিয়েছে। তার আগেই আইএইএ থেকে সব ধরনের সনদ নেওয়া হয়েছে।
আইএইএর নির্দেশনা অনুযায়ী শর্ত পূরণ করায় বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ গত ১৩ জুলাই বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনকে (বিএইসি) পারমাণবিক জ্বালানি আমদানি ও সংরক্ষণের লাইসেন্স দেয়। নিরাপত্তা নিশ্চিত করে পারমাণবিক জ্বালানি পরিবহনের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে রুশ প্রতিষ্ঠান বাররুস প্রজেক্ট এলসিসিকে। চুক্তি অনুসারে, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পে প্রথম তিন বছরের জন্য জ্বালানির দাম দিতে হবে না।
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র কর্তৃপক্ষের সূত্র বলছে, বিদ্যুৎকেন্দ্রের চুল্লিপাত্রে একবার পারমাণবিক জ্বালানি মজুত করা হলে তা দিয়ে এক বছর বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যাবে। এরপর আবার নতুন করে চুল্লিপাত্রে জ্বালানি মজুত করতে হবে।
এর আগে ২০২১ সালের অক্টোবরে রূপপুরে ইউনিট-১–এর ভৌত কাঠামোর ভেতরে চুল্লিপাত্র স্থাপনের মধ্য দিয়ে এই ইউনিটের কাজ প্রায় শেষ হয়েছে বলা যায়। এটি স্থাপনে আইএইএর মান অনুসরণ করতে হয়েছে।
চুল্লিপাত্র হচ্ছে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের মূল যন্ত্র। এই যন্ত্রের মধ্যেই পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের জ্বালানি হিসেবে ইউরেনিয়াম ভরা বা লোড করা হয়। আর গত বছরের অক্টোবরে বসানো হয় দ্বিতীয় ইউনিটের চুল্লিপাত্র।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিউক্লিয়ার ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক শফিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ইউরেনিয়াম বাংলাদেশে আসার মাধ্যমে রূপপুর প্রকল্পের একটি মাইলফলক অর্জিত হলো। তবে শিগগিরই বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে, বিষয়টি তা নয়। নানা রকম পরীক্ষা ও প্রস্তুতির পর বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হবে। তিনি বলেন, নিরাপত্তা নিশ্চিত করে উৎপাদন করা গেলে পারমাণবিক বিদ্যুৎসাশ্রয়ী এবং পরিবেশবান্ধব।
অধ্যাপক শফিকুল বলেন, পারমাণবিক বিদ্যুৎ যতটা না টেকনিক্যাল (কারিগরি), তার চেয়ে বেশি পলিটিক্যাল (রাজনৈতিক)।

আরও পড়ুন

মতামত দিন


The reCAPTCHA verification period has expired. Please reload the page.

আমাদের সম্পর্কে

We’re a media company. We promise to tell you what’s new in the parts of modern life that matter. Lorem ipsum dolor sit amet, consectetur adipiscing elit. Ut elit tellus, luctus nec ullamcorper mattis, pulvinar dapibus leo. Sed consequat, leo eget bibendum Aa, augue velit.