সংবাদপত্রে দেখলাম, গত ছয় মাসে এক দিবস ক্রিকেটে বাংলাদেশের মেয়েরা ৮টি খেলা জিতেছে। ভারতের সঙ্গে সিরিজে ড্র করেছে এবং পাকিস্তানের সঙ্গে সিরিজ জিতেছে। অবিস্মরণীয় সে সব সংবাদগুলো বিরাট করে তেমন একটা কোনো প্রচারমাধ্যমে আসেনি। উদ্দীপ্তভাবে ওঠে আসেনি আমাদের পারস্পরিক আলোচনায়। উত্তেজিত কণ্ঠে আমরা উচ্চারণ করিনি সেসব অর্জনের কথা। ভাবখানা যেন- এ আবার এমন কী, মেয়েরা আবার অমন কী খেলুড়ে এবং মেয়েদের জয় নিয়ে এত আদিখ্যেত্যের কী আছে?
কিন্তু হতো যদি এটা ছেলেদের বিজয়, তাহলে এতক্ষণে ঢাকার রাস্তায় হাজির বিরিয়ানির হাঁড়ি নেমে যেত, বিলি শুরু হয়ে যেত মিষ্টির, স্লোগানে মুখরিত হতো আশপাশ। প্রশস্তি বাক্যে ভারী হয়ে যেত আকাশ-বাতাস – ছেলেদের শৌর্য-বীর্যের গাথা রচিত হয়ে যেত। ‘আপনার অনুভূতি কি?’ – এ প্রশ্নের জবাব দেওয়ার জন্য কাড়াকাড়ি পড়ে যেত বিশিষ্টজনদের মধ্যে।
অথচ আমাদের মেয়েদের সাম্প্রতিক বিজয়গুলো ঐতিহাসিক ঘটনাই বটে। গত জুলাই মাসে ঢাকার মাঠে শ্বাসরুদ্ধকর তৃতীয় খেলাসহ বাংলাদেশের মাটিতেই একদিনের ক্রিকেটে সিরিজ ড্র করেছে বাংলাদেশ ললনারা ভারতের বিরুদ্ধে। এবং সম্প্রতি আবারও দেশের মাটিতেই পাকিস্তানের বিরুদ্ধে এক দিনের খেলায় সিরিজ জিতেছে বাংলাদেশ দল। প্রাণঢালা অভিনন্দন আমাদের কন্যাদের। জয়তু : বঙ্গকন্যারা। সবিনয়ে স্বীকার করি, দুই কন্যার জনক হিসেবে আমার আনন্দের পাল্লাটা একটু বেশি ভারী।
প্রথমেই বলে নেওয়া দরকার যে ক্রিকেটে ঐতিহাসিকভাবেই আমাদের মেয়েদের বিজয় ও অর্জনের একটি ধারাবাহিক স্হিতুমান আলেখ্য রয়েছে। ছেলেদের ক্ষেত্রে তা বলা যাবে না- তারা হয় সপ্ত আসমানে নয়; ধরণীতলে। তাদের খেলার ফলাফলে প্রায়ই সামঞ্জস্য বা ধারাবাহিকতা থাকে না – না দলগতভাবে, না ব্যক্তিগত পর্যায়ে। মেয়েদের খেলায় আস্থা রাখা যায়, এমন অর্জনে তাই গর্ব অনুভব করা উচিত এবং উদযাপিত হওয়া দরকার এমন বিজয়।
দ্বিতীয়ত এটাও বলা দরকার, ছেলেদের ক্রিকেট দল রাষ্ট্র, সরকার ও সমাজের কাছ থেকে যে পৃষ্ঠপোষকতা পায়, নারী ক্রিকেটদল তা পায় না। অর্থায়ন, খেলার নানা সুযোগ-সুবিধা, পারিতোষক, ব্যক্তিগত খেলোয়াড়দের সহায়তা এসবের সিংহভাগই ব্যবহৃত হয় পুরুষ খেলোয়াড়দের জন্য। সংবাদপত্র থেকে জানলাম, গত পাঁচ মাস ধরে কোনো বেতন পাচ্ছেন না নারী ক্রিকেটাররা। সত্যিকার অর্থে, নারী ক্রিকেটদলের সব কর্মকাণ্ড ঘটে একটি বৈরী পরিবেশে, প্রতিনিয়ত- নানা প্রতিকূলতার মধ্যে তাদের খেলা চালিয়ে যেতে হয়।
তৃতীয় বিষয়টি আমার নিজের ভাবনা। পাকিস্তানকে বাংলাদেশ হারিয়েছে – আমার কাছে এ জয়ের ব্যঞ্জনা অনেক বড়। ওই দেশটিকে যুদ্ধের মাঠে হারিয়েছি, উন্নয়নের মাঠেও সে আমাদের চেয়ে বহুদূরে পড়ে আছে এবং এখন ক্রিকেটের মাঠেও হারাচ্ছি – এ সুখ রাখি কোথায়? যে কোনো ক্ষেত্রে, যে কোনো বিষয়ে পাকিস্তানকে হারানোর মজাই তো আলাদা। সেই সঙ্গে এটাও বলি, ঢাকার মাঠে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের বিজয় দেখে যারা পাকিস্তানের পতাকা নিয়ে দু’হাত তুলে নৃত্যজুড়ে দিয়েছিলেন, আমাদের নারী ক্রিকেটদল তাদের গালে সপাটে একটি চড় বসিয়ে দিয়েছেন বটে।
শেষের কথা বলি। আমাদের নারীদের অর্জন স্বীকারে, উদযাপনে আমাদের এত অনীহা কেন? কারণ একটি পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীকে সদা খাট করে দেখা হয়। তাই আমাদের নারী ক্রিকেটদলের বিজয়কেও তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে দেখা হয়। প্রায়ই শোনা যায় ‘মেয়েদের ক্রিকেট আবার ক্রিকেট নাকি?’ ‘মেয়েরা কী ক্রিকেট খেলবে?’ এদের খেলা উচিত ‘দাঁড়িয়াবান্ধা’। সৌন্দর্য, বুদ্ধিমত্তা বাস্তবজ্ঞানে পিছিয়ে থাকা পুরুষ জাতি কখনও নারীর অর্জনকে ওপরে তুলে ধরবে না – কারণ অনিশ্চিত পুরুষ জাতি তাদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণে সদাব্যস্ত। আমাদের কন্যাদের বলি, আপনাদের ক্ষুদ্র করার এই অপপ্রচেষ্টায় আপনারা ক্ষুদ্র হন না, আমরা পুরুষরা খাটো হয়ে যাই। আপনারা জয়ী সর্ব অর্থেই, সর্ব ক্ষেত্রেই এবং সর্বকালেও।
ড. সেলিম জাহান : নিউইয়র্কে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন কার্যালয়ের সাবেক পরিচালক