সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ মনে করতেন, তাঁর ‘ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়’ অনেক বেশি সক্রিয়। যুক্তরাজ্যের সাবেক প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার মনে করতেন, তিনি যেকোনো অনুষ্ঠানে ‘গুরুত্বপূর্ণ অতিথি’ হওয়ার যোগ্যতা রাখেন। এবং এ জন্যই ফরাসি প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ তাঁকে তাঁর সরকারি অবকাশযাপন কেন্দ্রে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আলোচনার জন্য আমন্ত্রণ জানান।
আড়াই দশক ধরে রাশিয়ার ক্ষমতায় থাকা রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের ব্যাপারে পশ্চিমা নেতারা মনে করেন, তাঁরা ক্রেমলিনের নেতার কৌশল সম্পর্কে ভালোই বুঝতে পারেন। তাঁরা এই যুক্তিও দেখান যে আন্তর্জাতিক অংশীদার হিসেবে রাশিয়া গুরুত্বপূর্ণ একটা অবস্থানে থাকার দাবি রাখে।
কিন্তু দুই বছর আগে ২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি পুতিন ইউক্রেনে হামলা করে বসার পর তাঁর সম্পর্কে পশ্চিমাদের সব ধ্যানধারণা উল্টে যায়। ২০১৯ সালের আগস্টে ফরাসি প্রেসিডেন্ট মাখোঁর বাসভবন মেডিটারিয়ান ফোর্ট দে ব্রেজানকোঁতে তাঁর স্ত্রী ব্রিজিতের হাত থেকে ফুল নিতে সিঁড়ি বেয়ে ওপরের দিকে উঠতে থাকা পুতিনের হাস্যোজ্জ্বল ছবি এখন তাঁদের কাছে দূর অতীতের কোনো বিষয়।
প্রথম শীতে আকস্মিক আক্রমণ চালিয়ে ইউক্রেনের প্রধান প্রধান শহর দখলে নেওয়ার প্রাথমিক লক্ষ্য পূরণে পুতিন ব্যর্থ হলেও তিনি এখন ক্রমেই আত্মতৃপ্তির ঢেকুর তুলছেন। ২০২৩ সালের গ্রীষ্মে ইউক্রেনের বহুল প্রত্যাশিত পাল্টা আক্রমণ এবং দেশটির দক্ষিণ ও পূর্বের গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলগুলো রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণে দেখে বেশ খোশমেজাজে আছেন তিনি।
মস্কোর জন্য একটি প্রতীকী বিজয় হচ্ছে, কয়েক মাস যুদ্ধের পর গত সপ্তাহে পূর্ব ইউক্রেনীয় শহর আভদিভকা রুশ সেনাদের নিয়ন্ত্রণে এসেছে।
একই সঙ্গে রাশিয়ার পুতিনবিরোধীদের জন্য বড় একটি ধাক্কাও এসেছে। পুতিনের কড়া সমালোচক অ্যালেক্সি নাভালনি গত সপ্তাহে আর্কটিক কারাগারে মারা গেছেন। তাঁর দল বলছে, তাঁকে হত্যা করা হয়েছে।নাম প্রকাশ না করার শর্তে পশ্চিমা এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেন, ‘এটা সত্য, প্রেসিডেন্ট পুতিন এখন এ কারণে আত্মবিশ্বাসী যে তিনি পশ্চিমা বিশ্বকে ছাড়িয়ে যেতে পারবেন। তাই তাঁকে ভুল প্রমাণ করার মতো কিছু একটা করে দেখানো আমাদের দায়িত্ব।’
রাশিয়া লাভবান হচ্ছে
পুতিন ক্রমেই আত্মবিশ্বাসী বিবৃতি দিয়ে যাচ্ছেন। গত ডিসেম্বরে তিনি বিবৃতিতে বলেছিলেন, ইউক্রেনের ‘ভবিষ্যৎ নেই’। সম্প্রতি বিতর্কিত ডানপন্থী মার্কিন টিভি সাংবাদিক টাকার কার্লসনের সঙ্গে এক সাক্ষাত্কারে বলেছিলেন, রাশিয়ার কৌশলগত পরাজয় ‘প্রকৃত অর্থে অসম্ভব’।
পশ্চিমা নেতারা পুতিনের এই বক্তব্যের জোরালো জবাব দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। তাঁরা বলেছেন, ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে রাশিয়াকে পরাজিত করাই হচ্ছে তাঁদের একমাত্র বিকল্প। গত মাসে ফরাসি প্রেসিডেন্ট মাখোঁ ঘোষণা দিয়েছিলেন, ইউরোপের অগ্রাধিকার হতে হবে ‘রাশিয়াকে জিততে না দেওয়া’।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, ইউক্রেনের জন্য পশ্চিমা সমর্থন ব্যাপকভাবে বৃদ্ধির কোনো বিকল্প নেই। কারণ, দেশটির অস্ত্রশস্ত্র ফুরিয়ে গেলে যুদ্ধের গতি বদলে যেতে পারে।
কিন্তু এই সমর্থন ও সহায়তা নিশ্চিত করা এখন অনেক জটিল হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ, মার্কিন আইনপ্রণেতারা একটি নতুন সহায়তা প্যাকেজ নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে রয়েছেন। পুতিন চলতি বছরের নভেম্বরে অনুষ্ঠেয় মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের সম্ভাব্য বিজয়ের অপেক্ষা রয়েছেন। ইতিমধ্যে ইউরোপে বিভক্তি দেখা দিয়েছে।
ওয়াশিংটনভিত্তিক সেন্টার ফর নিউ আমেরিকান সিকিউরিটির (সিএনএএস) জ্যেষ্ঠ ফেলো আন্দ্রেয়া কেন্ডাল-টেলর বলেন, এটি উভয় পক্ষের আক্রমণাত্মক ক্ষমতা পুনর্গঠনের প্রতিযোগিতা।
টেলর বলেন, পশ্চিমা তহবিল না এলে এবং রাশিয়া কিছু সুবিধা পেলে আখেরে মস্কোর আরও বেশি কিছু অর্জন করার সম্ভাবনা দেখা দেবে। তিনি বলেন, উৎসাহ–উদ্দীপনা স্থানান্তর হয়ে গেছে।
কেন্ডাল-টেলর যোগ করেন, ইউক্রেন যদি ২০২৪ সালে তাদের সীমানা ধরে রাখতে পারে এবং নতুন সরঞ্জাম সহায়তা পেলে ২০২৫ সালে তারা রাশিয়ার ওপর আরও চাপ তৈরি করতে পারেবে।
টেলর বলেন, পুতিনের দিক থেকে ২০২৪ সাল বেশ গুরুত্বপূর্ণ।
ইউক্রেন ট্রাম্পের হোয়াইট হাউসে ফিরে আসার সম্ভাবনা নিয়ে ভয়ানক চিন্তিত। তিনি ২০২৩ সালে স্পষ্টই ঘোষণা দিয়েছিলেন, তিনি আবার নির্বাচিত হলে ‘সেই যুদ্ধ এক দিন, ২৪ ঘণ্টার মধ্যে’ নিষ্পত্তি করবেন।
বিশ্লেষকদের আশঙ্কা, উগ্র ডানপন্থী দলগুলো রাশিয়ার বিরুদ্ধে নরম অবস্থান নিতে পারে। ফ্রান্স ও জার্মানিতে ইতিমধ্যে ডানপন্থীদের সমর্থন বেড়েই চলেছে।
উদ্বেগের কারণ
গবেষণা প্রতিষ্ঠান আর পলিটিক কনসালটেন্সির প্রতিষ্ঠাতা তাতিয়ানা স্ট্যানোভায়া বলেছেন, পশ্চিমের দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে যুদ্ধের গতিপথ রাশিয়ার পক্ষে ঘুরিয়ে দেওয়ার জন্য পুতিন ২০২৪ সালকে ‘বড় সুযোগ’ হিসেবে দেখেছেন।
তাতিয়ানা ধারণা করছেন, পুতিন ইউক্রেনে পশ্চিমা সামরিক সহায়তায় সাময়িক ছেদ আশা করছেন। গোলাবারুদ উৎপাদন ২০২৫ সালের প্রথম দিকে বাড়বে বলে আশা করা হচ্ছে।
সামনে মার্কিন নির্বাচন। এ অবস্থায় কিয়েভকে সমর্থন করার মতো ভূরাজনৈতিক কৌশলের দিকে যুক্তরাষ্ট্র কম নজর দিতে পারে। অন্যদিকে ইউরোপীয় ইউনিয়নে নিজেদের মধ্যে মতানৈক্য রয়েছে। ফলে কিয়েভের সমর্থনে তাদের ক্ষতি পূরণ দেওয়ার সম্ভাবনা কম।
অন্যদিকে রাশিয়ার অর্থনীতি যুদ্ধের মধ্যে রয়েছে। সংঘাতের মধ্যে জনসাধারণের মধ্যে ক্লান্তির লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। ইতিমধ্যে রাশিয়া বিরাট ক্ষতির মুখে পড়েছে।
পশ্চিমারা বলছে, এ পর্যন্ত রাশিয়ার পক্ষে ৩ লাখ ৫০ হাজার সৈন্য হতাহত হয়েছে। সুতরাং রাশিয়ার অভ্যন্তরীণ দুর্বলতা পশ্চিমাদের কিছুটা আশান্বিত করতে পারে।
পশ্চিমা কর্মকর্তারা বলেন, এমন কিছু জিনিস রয়েছে যা পুতিনের জন্য সত্যিই উদ্বেগের কারণ হতে পারে। প্রতিরক্ষা ও নিরাত্তায় সরকারের বিপুল ব্যয় রাশিয়ার অর্থনীতিতে দীর্ঘমেয়াদি কিছু বাস্তব সমস্যা সৃষ্টি করেছে।
কার্নেগি এনডাউমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল পিসের জ্যেষ্ঠ ফেলো ডারা ম্যাসিকট বলেন, অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতায় ভারসাম্য রক্ষায় পুতিনকে অনেক সময় দিতে হচ্ছে।
ডারা বলেন, ‘তবে উল্লেখযোগ্য পশ্চিমা সমর্থন ছাড়া ইউক্রেন আলোচনা–সমঝোতার ক্ষেত্রে কোন অবস্থানে থাকবে, সেটা আমি জানি না। এটি একটি ভয়ংকর ব্যাপার হতে পারে।
পূর্ববর্তী পোস্ট