প্যারিসে ২৬ জুলাই থেকে শুরু হবে ক্রীড়া বিশ্বের সবচেয়ে বড় ক্রীড়া আসরটি, যাকে বলা হয় ‘দ্য গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ’। ক্রীড়াবিদ, কোচ ও ম্যানেজারদের ১৩ সদস্যের বাংলাদেশ দল তিনভাগে অলিম্পিকে গেছেন। আরচারি ও শূটিং দল ২০ জুলাই এবং বাকি দুই ডিসিপ্লিনের আরও তিনজন ২৩ ও ২৪ জুলাই দুইভাগে গেছেন প্যারিসে।
১৯৮৪ সাল থেকে অলিম্পিকে অংশ নিয়ে আসলেও আজ পর্যন্ত ন্যূনতম একটি ব্রোঞ্জপদকও পায়নি বাংলাদেশ। এখন দেখা যাক, এবারের প্যারিস অলিম্পিকে বাংলাদেশের কোন্ পাঁচ ক্রীড়াবিদ অংশ নিচ্ছেন, তাদের প্রস্তুতি কেমন এবং লক্ষ্যটা কি। জানাচ্ছেন তামিম হাসান ইফতি
ইমরানুর রহমান (অ্যাথলেটিক্স, ১০০ মিটার স্প্রিন্ট)
বাংলাদেশের দ্রুততম মানব ইমরানুর রহমান। এবারের অলিম্পিকে এই লন্ডনপ্রবাসী তারকা স্প্রিন্টারের লক্ষ্য পরের রাউন্ডে যাওয়া। চান যতটা সম্ভব ভালো করতে। সেটা যেন স্মরণীয় কিছু হয়।
যদিও ভালোভাবেই জানেন এই লক্ষ্যপূরণ করাটা কতটা কঠিন। তবে চেষ্টার কোনো কমতি রাখবেন না তিনি। এজন্য অবশ্য আলাদাভাবে কিছু করেননি। সারা বছর যেভাবে প্রস্তুতি নেন, সেভাবেই নিয়েছেন। তবে অনুশীলনের মাত্রা বেশি ছিল।
গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন হুট করেই অলিম্পিকে গিয়ে বড় কিছু করে ফেলা সম্ভব নয়। এজন্য প্রয়োজন পরিকল্পনামাফিক অগ্রসর হওয়া। সঙ্গে পৃষ্ঠপোষকের সমর্থনও। দেশের দ্রুততম মানব হিসেবে অলিম্পিকে অংশ নেওয়াটা কি চাপের? এটাকে অস্বীকার করেননি ইমরানুর। চান ট্র্যাকে সেভাবেই খেলতে।
বিশ্ব ইনডোর অ্যাথলেটিক্সের সাফল্যের পর বড় কিছু করতে না পারেননি ইমরানুর। অবশ্য তিনি তাতে দ্বিমত পোষণ করেন। কেনন এরপর জাতীয় রেকর্ড গড়েছেন। দ্রুততম মানবের রেকর্ড ধরে রেখেছেন। জাতীয় অ্যাথলেটিক্সে ১০০ মিটার স্প্রিন্টে ইমরানুরের বর্তমান টাইমিং ১০.৪৯ সেকেন্ড। যদিও তার সেরা টাইমিং ১০.০১ সেকেন্ড। অলিম্পিকে টাইমিং কেমন থাকবে? এ নিয়ে কোনো নিশ্চয়তা দেননি ইমরানুর। শুধু বলেছেন, ‘দেখা যাক পারি কি না।’
সামিউল ইসলাম রাফি (সাঁতার, ১০০ মিটার ফ্রিস্টাইল)
২০১৬ সালে ‘সেরা সাঁতারু খোঁজে’ ট্যালেন্ট হান্ট প্রকল্প থেকে উঠে আসেন রাজবাড়ীর ছেলে রাফি। এটাই তার প্রথম অলিম্পিক। প্রত্যেক অ্যাথলেটেরই স্বপ্ন থাকে অলিম্পিকে অলিম্পিকে অংশ নেওয়া। রাফিরও তাই। খুবই রোমাঞ্চিত বোধ করছেন। কারণ সেখানে অনেক বড় খেলোয়াড় আসবে। ওয়াইল্ড কার্ডের মাধ্যমে না গিয়ে সরাসরি নিজের যোগ্যতায় অলিম্পিকে যেতে পারলেই বেশি ভালো লাগতো রাফির।
অলিম্পিকের মতো আসরে সেমিফাইনাল বা সরাসরি কোয়ালিফাই করতে গেলে কমপক্ষে ছয় থেকে সাত বছর ট্রেনিং করতে হয়। বাইরের দেশে একটা গেমসকে টার্গেট করে তারা ৮-৯ বছর ধরে প্রস্তুতি নেয়। সেক্ষেত্রে রাফিরা সঠিক ট্রেনিং পান না। ধারবাহিকভাবে ট্রেনিং না হওয়াটা বাংলাদেশে বড় সমস্যা। যদিও রাফি গত ডিসেম্বর থেকে অলিম্পিকের আগ পর্যন্ত থাইল্যান্ডে ট্রেনিং করেছেন। ১০০ মিটার ফ্রিস্টাইলে তার সেরা অফিসিয়াল টাইমিং ছিল ৫৬ সেকেন্ড।
ট্রেনিং করার পর ৩ সেকেন্ড কমিয়ে এনেছেন। অলিম্পিকে ৫২ সেকেন্ড টাইমিং করাই এখন তার মূল লক্ষ্য। অলিম্পিকের হিটেই বাদ পড়া হচ্ছে বাংলাদেশি ক্রীড়াবিদদের অবধারিত পরিণতি। এ নিয়ে রাফির উত্তর, ‘যারা কোয়ালিফাই করে, তারাও অনেক সময় সেমিফাইনালে উঠতে পারে না। এটা আসলে টাইমিংয়ের গ্যাপ। বলা যায় আমাদের জন্য হিটের প্রথম ধাপ পার হওয়াটা অসম্ভবই। আমার লক্ষ্য ২০২৮ অলিম্পিকে সরাসরি খেলার। সেই লক্ষ্যেই এগিয়ে যাচ্ছি।’
সাগর ইসলাম (আরচারি, রিকার্ভ)
প্যারিস অলিম্পিকের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের মার্চপাস্টে লাল-সবুজের পতাকা নিয়ে বাংলাদেশ কন্টিনজেন্টের নেতৃত্ব দেবেন অলিম্পিক গেমসে সরাসরি খেলার যোগ্যতা অর্জন করা আরচার সাগর ইসলাম। সরাসরি অলিম্পিকে খেলার অনুভূতি কেমন? ‘এ নিয়ে তেমন কোনো অনুভূতি নেই।
তবে অলিম্পিকে সুযোগ পেয়ে অবশ্যই রোমাঞ্চিত। গত মাসে অলিম্পিকে কোয়ালিফাই করার পর কোচ ফ্রেডরিখ মার্টিন স্যার আমার অনুশীলনের মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছেন। বিশ্বের সবচেয়ে বড় ক্রীড়া প্রতিযোগিতার জন্য তো বাড়তি অনুশীলন করতেই হবে।’ সাগরের জবাব। টঙ্গীর শহীদ আহসান উল্লাহ মাস্টার স্টেডিয়ামে নির্মাণকাজ চলছে, স্টেডিয়ামের বাইরে ট্রাক-বাসের অবিরাম হর্নের শব্দ। কিন্তু এতে বরং ভালোই হয়েছে সাগরের জন্য। কেননা অলিম্পিকে গেলে স্টেডিয়ামে দর্শকদের চিৎকারের মধ্যেই খেলতে হবে। ফলে টঙ্গীর পরিবেশে অনুশীলন করে বরং মনোসংযোগ বাড়ানোর চেষ্টা করেছেন।
এবার প্যারিস অলিম্পিকে বিভিন্ন ইভেন্টে ৬২ আরচার অংশ নেবেন। সাগর তাদেরই একজন। তবে এসব মাথায় রাখছেন না সাগর। তুরস্কে ওয়ার্ল্ড কোটা টুর্নামেন্টে সেমিফাইনালে উঠেছিলেন ৬৬০ স্কোর গড়ে। এই স্কোর ধরে রেখে এগুতে চান সাগর।
সোনিয়া আক্তার (সাঁতার, ৫০ মিটার ফ্রিস্টাইল)
১৯৯২ বার্সেলোনা অলিম্পিকে প্রথম বাংলাদেশি নারী হিসেবে অলিম্পিকে অংশ নিয়েছিলেন শুটার কাজী শাহানা পারভীন।
এরপর আরও অনেকেই অংশ নিয়েছেন। এবার পালা কার? এবারের প্যারিস অলিম্পিকে বাংলাদেশের যে ৫ ক্রীড়াবিদ অংশ নেবেন, তাদের মধ্যে একমাত্র নারী সোনিয়া আক্তার। তবে এজন্য নয়, সোনিয়া রোমাঞ্চিত বিশ্ব ক্রীড়াঙ্গনের সবচেয়ে বড় মঞ্চ অলিম্পিকে অংশ নেবেন বলে। কেননা সবসময় তো বিশ্বের সেরা সাঁতারুদের সঙ্গে এক পুলে সাঁতার কাটার সৌভাগ্য হয় না।
নিজের সেরা টাইমিং করাই সোনিয়ার মূল লক্ষ্য। নিজেকে ছাড়িয়ে যেতে পারলে দারুণ হবে। ফলে আগামীর রসদপা পাওয়া হবে। অলিম্পিকের পুলে নামার অভিজ্ঞতাটা যেন ভালো হয়, সেই লক্ষ্যেই প্রস্তুতি নিয়েছেন সোনিয়া। মূলত অনুশীলনের ওপরই জোর দিয়েছেন তিনি। সাভারের জিরানির বিকেএসপিতে টানা অনুশীলন করেছেন। সাঁতার ফেডারেশনের কবাছ থেকে সব ধরনের সহযোগিতা পেয়েছেন। তিনি যেহেতু নৌবাহিনীর একজন সাঁতারু, সেহেতু নৌবাহিনীও তাকে অনেক সাহায্য করেছে।
এখনো কেন অলিম্পিকে শুধুই অংশ নেওয়ার জন্যই অংশ নেয় বাংলাদেশ? সোনিয়া বলেন, ‘এটাই আসলে বাস্তবতা। পদকের লড়াই অনেক বড় ব্যাপার আমাদের কাছে। এখনো এদেশের সাঁতারুরা হ্যান্ডটাইমিংয়েই আটকে আছেন! কিন্তু অলিম্পিকে তো থাকবে ইলেকট্রনিক টাইমিং।’
রবিউল ইসলাম (শুটার, ১০ মিটার এয়ার রাইফেল)
‘প্রথমবার অলিম্পিকে খেলব। অবশ্যই রোমাঞ্চিত। অনুশীলনের মাত্রা বেড়ে গিয়েছিল। প্রচুর পরিশ্রম করেছি। অলিম্পিকে শুধু অংশ নেওয়ার জন্য অংশ নিতে চাই না, ভালো করতে চাই। সেভাবেই প্রস্তুতি নিয়েছি।’ কথাগুলো শুটার রবিউল ইসলামের। এবার অলিম্পিকে তার লক্ষ্য থাকবে সেরা আটে খেলার। সেরা আট মানে পদকের লড়াই। রবিউল মনে করেন, এমন লক্ষ্য নিয়ে খেললেই ভালো কিছু করা সম্ভব। অনুশীলনে ৬৩০ পয়েন্ট স্কোর করেছেন ইমরানুর। সবসময়ই অবশ্য এমন হয়নি, তবে এর কাছাকাছিই স্কোর থেকেছে। বিদেশের প্রতিযোগিতাগুলোতে ৬২৮ বা ৬২৭ স্কোর করেছেন। ৬৩০-এর কাছাকাছি করতে পারলে লক্ষ্যপূরণ খুবই সম্ভব। অল্পের জন্য সরাসরি অলিম্পিকে সুযোগ পাননি। এ নিয়ে আক্ষেপ আছে রবিউলের। এ বছরের জানুয়ারিতে ইন্দোনেশিয়ায় এশিয়ান শূটিং চ্যাম্পিয়নশিপে মাত্র ০.৩ পয়েন্টের জন্য সরাসরি অলিম্পিকে খেলার সুযোগ হাতছাড়া হয়ে যায় তার। স্কোর করেছিলেন ৬২৮।
এজন্য তখন মানসিকভাবে একটু বিধ্বস্তই ছিলেন। তবে শূটিং ফেডারেশন তখন রবিউলকে অনেক উৎসাহ দিয়েছে। গত এপ্রিলে রিওতে ৬২৭ স্কোর করার পর শুনলেন ওয়াইল্ড কার্ড পাবার সম্ভাবনা আছে। তবে সরাসরি খেলতে পারলেই বেশি খুশি হতেন তিনি। শূটিংয়ে মানসিক প্রস্তুতিটা অনেক বেশি নিতে হয়। এজন্য ইয়োগা ও মেডিটেশন দুটিই করেছেন রবিউল। পাবনার ছেলে তিনি। সেখানে রাইফেল ক্লাব আছে। তার চাচা সেই ক্লাবের কর্মকর্তা। সে সুবাদে ক্লাবে গিয়ে অনুশীলন করতেন। এভাবেই শূটিংয়ে আসা। পরে বিকেএসপিতে ভর্তি হন। শূটিংই তার ধ্যানজ্ঞান।
পূর্ববর্তী পোস্ট