ভারতে ক্রিকেট বিশ্বকাপ চলছে। দশ দলের বিশ্বকাপ। প্রথম রাউন্ডে সবাই সবার মুখোমুখি হবে। অর্থাৎ একেক দল নয়টি করে ম্যাচ পাবে।
প্রতিটা ম্যাচে জয়ী দল পাবে ২ পয়েন্ট করে, ম্যাচ টাই বা পরিত্যাক্ত হলে প্রতিটি দল এক পয়েন্ট করে পাবে। সুতরাং প্রথম রাউন্ড শেষে সবচেয়ে বেশি পয়েন্ট পাওয়া চার দল সেমিফাইনালে খেলবে।
কিন্তু ব্যাপারটা এমন সরল নাও হতে পারে। এমনও হতে পারে একাধিক দলের পয়েন্ট সমান।
ধরা যাক, তিনটি দল পয়েন্টের হিসাবে সবচেয়ে এগিয়ে। তাদের সেমিফাইনাল খেলতে কোনোরকম হিসাব-নিকাষের আর দরকার নেই। কিন্তু ঝামেলা দেখা দিল চতুর্থ দল নির্বাচনে। দেখা গেল তিনটি দল সমান পয়েন্ট পেয়েছে।
তখন কী হবে?
ব্যাপারটা খুব সহজ। তখন নেট রানরেটের যে দল এগিয়ে থাকবে সেই দল সেমিফাইনাল খেলবে।
আপনি কি জানেন, কীভাবে এই নেট রানরেটের হিসাব হয়?
না জানলেও ক্ষতি নেই। আমরা এখন সেই নেট রানরেটের হিসাব বের করব। জটিল গণিত মনে করে ভয় পাবেন না।
স্কুলের সাধারণ পাটিগণিত ব্যবহার করেই আমরা হিসাবটা বের করে ফেলব।
প্রথমে সবচেয়ে সহজ হিসাবটা করে ফেলা যাক। নির্দিষ্ট একটা ম্যাচে কীভাবে নেট রান রেট হিসাব করা হয়?
ধরা যাক, এই বিশ্বকাপে বাংলাদেশ আর আফগাননিস্তান ম্যাচের কথা। আফগাননিস্তান প্রথমে ব্যাট করেছে ৩৭.২ ওভারে ১৫৬ রান করেছে। সেই হিসাবে ওই ম্যাচে আফগানিস্তানের রানরেট ছিল ওভার প্রতি ৪.১৭। অর্থাৎ ১৫৬ ÷ ৩৭.২ = ৪.১৯। কিন্তু এখানে একটা ফাঁক আছে। ৩৭.২ ওভার মানে ৩৭ ওভার ২ বল। কিন্তু প্রতি ওভারে ৬টি করে বল হয়, ১০টি বল নয়। ক্রিকেট খেলার স্কোর লেখার সময় ৩৭.২ লেখা হলেও দশভিত্তিক সংখ্যাতত্ত্বে সেটা ৩৭.২ নয়। রান রেটের হিসাব অবশ্যই দশভিত্তিক সংখ্যায় হয়। সেক্ষেত্রে ৩৭ ওভার দুই বলকে সত্যিকারে দশমিকে প্রকাশ করতে হলে আরেকটু হিসাব করতে হবে। ৩৭ ওভার ২ বল মানে আফগানিস্তান মোট বল খেলেছে ২২৪ বল। তাহলে দশমিকের হিসেবে তারা খেলেছে (২৪৪ ÷ ৬) = ৩৭.৩৩ ওভার। সুতরাং আফগানিস্তানের রান রেট ১৫৬ ÷ ৩৭.৩৩ = ৪.১৭।
আফগানিস্তান পুরো পঞ্চাশ ওভার খেলতে পারেনি। তাই ওদের ওই নেট রান রেটের সময় ৩৭.৩৩ ওভার নয়, হিসাব করতে পুরো পঞ্চাশ ওভারের। সেক্ষেত্রে ওই ম্যাচে আফগানিস্তানের রান রেট ওভার প্রতি (১৫৬ ÷ ৫০) = ৩.১২ রান।
এবার বাংলাদেশের রানরেটের হিসাবটা দেখা যাক। আফগানিস্তানের ১৫৬ রানের জবাবে বাংলাদেশ ১৫৮ রান করেছে ৩৪.৪ ওভারে। এখানেও সেই ছয় বলের হিসেবে ৩৪.৪ ওভারি লেখা হয়েছে। আসলে বাংলাদেশ মোট খেলেছে ২০৮ বল। অর্থাৎ (২০৮ ÷ ৬) = ৩৪.৬৬৭ ওভার। সুতরাং বাংলাদেশের রান রেট (১৫৮ ÷ ৩৪.৬৬৭) = ৪.৫৫৮। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে পুরো পঞ্চাশ ওভার ধরা হয়নি কারণ, বাংলাদেশ জয়ী দল। জয়ী দল এই সুবিধাটা পায়।
এবার এই ম্যাচ থেকে নেট রান রেটের হিসাবটা দেখা যাক। খুব সহজ, এক দলের রানরেটের সঙ্গে আরেক দলের রানরেট বিয়োগ করলেই নেট রান রেট পেয়ে যাব।
বাংলাদেশের নেট রান রেট = বাংলাদেশের রান রেট – আফগানিস্তানের রান রেট = ৪.৫৫৮-৩.১২০ = ১.৪৩৮।
অন্যদিকে আফগানিস্তানের নেট রান রেট = আফগানিস্তানের রান রেট – বাংলাদেশের রানরেট = ৩.১২০-৪.৫৫৮ = -১.৪৩৮। অর্থাৎ আগনিস্তানের রানরেট ঋণাত্মকভাবে বাংলাদেশে সমান। আর ঋণাত্মক মানে শূন্যের চেয়ে কম। সেই হিসেবে আফগানিস্তানের রানরেট খুব খারাপ।
এবার ধরা যাক, বাংলাদেশে আগে ব্যাট করে কোনো ম্যাচে ৪০ ওভারে অলআউট হলো ২০০ রানে। কিন্তু জিতে গেল ম্যাচটা। তখন কিন্তু বাংলাদেশের রান রেট ওই ম্যাচে (২০০ ÷ ৪০) = ৫ হবে না। আসলে জয়ী হওয়ার চেয়ে অল আউট হওয়ার গুরত্ব বেশি দেওয়া হয়। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের রান রেট হবে ওভার প্রতি (২০০ ÷ ৫০) = ৪।
ধরা যাক, সেই ম্যাচে প্রতিপক্ষ ২০ ওভারে ১৫০ রানে অল আউট হয়ে গেল। সাধারণভাবেই ওই দলের রান রেট (১৫০ ÷ ২০) = ৭.৫ না হয়ে হবে (১৫০ ÷ ৫০) = ৩। তখন ওই ম্যাচ থেকে বাংলাদেশের নেট রান রেট হবে (৪-৩) = ১। প্রতিপক্ষের -১।
প্রথম রাউন্ড শেষে বাংলাদেলের নেট রানরেট কেমন হবে?
অনেকে মনে করেন, প্রতি ম্যাচের নেট রান রেট যোগ করে, সেই যোগফলকে ৯ দিয়ে ভাগ করলেই নেট রানরেট পেয়ে যাব। ব্যাপরটা এমন নয়। এক্ষেত্রে বাংলাদেশে ৯ ম্যাচে মোট কত রান করেছে, সেটাকে মোট কত ওভার খেলেছে সেটা ভাগ দিলেই বাংলাদেশের রান রেট পাওয়া যাবে। তখন প্রতিপক্ষ বাংলাদেশের বিপক্ষে মোট কত ওভারে মোট কত রান নিয়েছে সে হিসাবও করতে হবে। সেখান থেকে বের করতে হবে বাংলাদেশের বিপক্ষে প্রতিপক্ষের রান রেট।
ধরা যাক, বাংলাদেশ নয় ম্যাচে মোট করেছে ২২৫০ রান। এর মধ্যে আগে ব্যাট করে দুটি ম্যাচে অলআউট হয়েছে একটাতে ৩০ ওভারে আর একটাতে ৪০ ওভারে। কিন্তু হিসেবের সময় এই দু ম্যাচে ৫০ ওভার করে ধরা হবে। অন্যদিকে আফগানিস্তানের সঙ্গে ৩৪.৬৬৭ ওভারে এবং আরেকটি ম্যাচে ৪৬.৫ ওভার ব্যাট করে রান তুলে দিয়েছে। তখন হিসেবের সময় এই ওভারগুলোই হিসাব করতে হবে।
বাংলাদেশ নয় ম্যাচে মোট খেলেছে ৩৪.৬৬৭+৫০+৫০+৫০*+৫০+৪৬.৫+৫০+৫০+৫০=৪৩১.১৬৭ ওভার। এখানে * দেওয়া ম্যাচগুলোতে বাংলাদেশে অলআউট হয়েছে। আগে কিংবা পরে ব্যাট করেই হোক, অলআউট হলে রানরেটের সময় মোট রানকে পুরো ৫০ ওভার দিয়ে ভাগ করতে হবে।
এখন, নয় ম্যাচে বাংলাদেশের রান রেট হবে (২২৫০÷৪৩১.১৬৭) = ৫.২১৮। অন্যদিকে ধরা যাক, প্রতিপক্ষ ৪৪০ ওভারে রান করেছে ২০৪৫ রান। বাংলাদেশের বিপক্ষে প্রতিপক্ষের রান রেট (২০৪৫÷ ৪৪০)=৪.৬৪৮।
বাংলাদেশের নেট রানরেট তাহলে = বাংলাদেশের রান রেট – প্রতিপক্ষের রান রেট = ৫.২১৮-৪.৬৪৮ =০.৫৭।
ধরা যাক, নয় ম্যাচ শেষে আফগানিস্তানের পয়েন্টেও বাংলাদেশের সমান। এবং বাংলাদেশ আর আফগানিস্তানের মধ্যে নেট রান রেটের হিসেবে যে দল বেশি থাকবে, সেই দল সেমিফাইনালে চলে যাবে।
ধরা যাক, আফগানস্তিান ৪৪৫ ওভারে মোট ২১২০ রান তুলেছে। অন্যদিকে প্রতিপক্ষ ৪৩৮ ওভারে তুলেছে ২০৭০ রান। তাহলে আফগানিস্তারের রান রেট হবে আগের মতো করে হিসাব করলে ৪.৭৬৪। অন্যদিকে প্রতিপক্ষের রানরেট ৪.৭২৬। সুতরাং আফগানিস্তানের নেট রানরেট = ৪.৭৬৪ – ৪.৭২৬ = ০.০৩৮।
স্পষ্টভাবে নেট রানরেটে আফগানিস্তানের চেয়ে বাংলাদেশে এগিয়ে। তাই বাংলাদেশ সেমিফাইনালে চলে যাবে।
নয় ম্যাচ শেষে কোনো দলের নেট রান রেট ঋণাত্মকও হতে পারে, যদি প্রতিপক্ষের ওভার প্রতি রানের চেয়ে প্রতিপক্ষের ওভার প্রতি রান বেশি হয়।
নয় ম্যাচ শেষে দেখা গেল, একটা দলের নেট রান রেট শূন্য। এর মানে ওভার প্রতি যে রান তারা করেছে, প্রতিপক্ষও ওভার প্রতি সেই রান করেছে। ধরা যাক, এই দলের সমান পয়েন্ট পেয়েছ আরেক দল। সেই দলের নেট রানরেট অবশ্য ঋণাত্মক, ধরা যাক, সেটা -০.০০৩। ঋণাত্মক সংখ্যার চেয়ে শূন্য যেহেতু বড়, তাই শূন্য রেটের দলটিই এগিয়ে।
নেট রানরেট কখনো কখনো আর্থিকভাবেও লাভবান করে। এ বছরের এশিয়া কাপের কথাই ধরা যাক। সুপার ফোর রাউন্ড থেকে সবার আগে বাদ পড়েছে বাংলাদেশ। তখনো অবশ্য এক ম্যাচ বাকি বাংলাদেশের। সেটা ভারতের সঙ্গে। হিসাব দাঁড়িয়েছিল, বাংলাদেশ যত বড় ব্যবধানেই ভারতের সঙ্গে জিতকু, বাদ পড়া নিশ্চিত তাদের। অন্যদিকে পাকিস্তান শ্রি লংকার সঙ্গে জিতলেই ফাইনালে চলে যত। এই যখন অবস্থা, বাংলাদেশের চতুর্থ হওয়ার কথা এশিয়া কাপে। কিন্তু সেটা হয়নি। কারণ, বাদ পড়া নিশ্চিত হওয়ার পরও বাংলাদেশ ভারতকে শেষ ম্যাচে হারিয়ে দেয়। অন্যদিকে পাকিস্তান শ্রিলংকার সঙ্গে স্নায়ুক্ষয়ি ম্যাচে শেষ মুহুর্তে হেরে যায়। তখন হিসাব যায় উল্টে। এর আগে পাকিস্তান ভারতের সঙ্গে ২২৮ রানের বিশাল ব্যবধানে হেরেছিল। তাই তাদের রানটেরে অবস্থা ছিল জঘন্য। শ্রিলংকার সঙ্গে জিতলে পয়েন্ট বেশি হত। সেক্ষেত্রে রানরেটে খারাপ হলেও ফাইনালে যেতে সমস্যা হত না। পাকিস্তান জিতলে বাংলাদেশ চতুর্থ হতো, কারণ শ্রিলংকার চেয়ে রানরেটে পিছিয়ে ছিল।
পাকিস্তান হেরে যাওয়ায় শ্রিলংকা ফাইনালে পৌঁছে যায়। বাংলাদেশ আর পাকিস্তান বাদ পড়ে সুপার ফোর থেকেই। মজার ব্যাপার হলো, বাংলাদেশের কোনো আশা না থাকলেও পাকিস্তানের চেয়ে নেট রানরেট ভালো ছিল। তাই বাংলাদেশে তৃতীয় ও পাকিস্তান চতুর্থ হয়ে এশিয়াকাপ শেষ করে। তৃতীয় হওয়ার কারণে বাংলাদেশ এসিসির কাছ থেকে প্রায় ৭০ লাখ টাকা পায়। অন্যদিকে পাকিস্তান পায় ত্রিশ লাখের একটু বেশি। সুতরাং নেট রানরেট শুধু পরের রাউন্ডে যেতেই ভূমিকা রাখে না, আর্থিকভাবেও আপনাকে ধনী করে দিতে পারে।
পূর্ববর্তী পোস্ট