গত সপ্তাহে মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশের কিয়াউকফুতে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের দরপত্র আহ্বান করেছে জান্তা সরকার। বাংলাদেশের কাছাকাছি ভারতের পশ্চিমবঙ্গের তাজপুরেও গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করতে যাচ্ছে ভারতের আদানি শিল্পগোষ্ঠী। তবে নির্মাণকাজ শুরুর আগে সমীক্ষা, নকশা তৈরির কাজ এখনো হয়নি। ঠিক এমন সময় বাংলাদেশে প্রথম গভীর সমুদ্রবন্দরের একটি টার্মিনালের নির্মাণকাজ শুরু হতে যাচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গতকাল শনিবার কক্সবাজারের মহেশখালীর মাতারবাড়ীতে বঙ্গোপসাগরের উপকূলে গভীর সমুদ্রবন্দরের টার্মিনালের নির্মাণকাজ উদ্বোধন করেছেন। সাগর থেকে এই টার্মিনালে জাহাজ আনা–নেওয়ার পথ তৈরি হয়েছে আগেই। প্রায় ১৪ কিলোমিটার লম্বা এই নৌপথও আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেছেন প্রধানমন্ত্রী। এই নৌপথে যাতে সাগরের ঢেউ আসতে না পারে, সে জন্য ঢেউ সামলানোর বাঁধ দিয়ে ব্রেক ওয়াটার বা স্রোত প্রতিরোধকের মতো জটিল কাজও শেষ হয়েছে।
শুধু নিজেদের পণ্য পরিবহনের চিন্তা করলে মাতারবাড়ী সমুদ্রবন্দরের ব্যস্ততা খুব বাড়বে না। এ জন্য ভারতের সাত রাজ্য, নেপাল, ভুটান, মিয়ানমার ও চীনের একাংশের পণ্য পরিবহন নিশ্চিত করতে হবে।
মইনুল ইসলাম, সাবেক অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
মাতারবাড়ীতে জাপানের সহায়তায় দুটি জাহাজ ভেড়ানোর গভীর সমুদ্রবন্দরের এই টার্মিনাল চালু হওয়ার কথা রয়েছে ২০২৬ সালে। অন্যদিকে চীনের সহায়তায় মিয়ানমারের কিয়াউকফুতে যে গভীর সমুদ্রবন্দর তৈরি করা হচ্ছে, সেটি মাতারবাড়ীর আগে চালু হওয়ার সুযোগ কম। আবার হিনডেনবার্গ রিসার্চের প্রতিবেদনের পর ধাক্কা খাওয়া আদানি শিল্পগোষ্ঠী তাজপুরে নির্মাণকাজ কখন শুরু করতে পারবে, তা এখনো নিশ্চিত নয়। অর্থাৎ ভারতের পূর্ব উপকূলের অন্ধ্র প্রদেশের পর থেকে মিয়ানমার পর্যন্ত বিশাল উপকূলীয় এলাকায় প্রথম মাথা তুলবে বাংলাদেশের মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর।
মাতারবাড়ীতে জাহাজ চলাচলের নৌপথের স্বাভাবিক গভীরতা ১৬ মিটার, যাতে ১৪ মিটার ড্রাফটের (জাহাজের পানির নিচের অংশের দৈর্ঘ্য) জাহাজ অনায়াসে চলতে পারবে। বাংলাদেশের কাছাকাছি এখন ভারতের অন্ধ্র প্রদেশে মাতারবাড়ীর মতো অর্থাৎ ১৬ মিটারের বেশি গভীরতার সমুদ্রবন্দর রয়েছে। বাংলাদেশ থেকে এ বন্দরে জাহাজ যেতে সময় লাগে তিন দিন।
গভীর সমুদ্রবন্দর থেকে ইউরোপে সরাসরি জাহাজ পরিষেবা চালু আছে। যেমন ভারতের কৃষ্ণপট্টনাম বন্দর থেকে ইউরোপে সরাসরি কনটেইনার জাহাজসেবা চালু রয়েছে। মাতারবাড়ী বন্দর চালু হলে এই বন্দর থেকেও সরাসরি ইউরোপ–আমেরিকায় জাহাজ চলাচলের সুযোগ তৈরি হবে। অবশ্য সরাসরি জাহাজ পরিষেবা চালুর জন্য নিয়মিত আমদানি–রপ্তানিবাহী কনটেইনার পেতে হবে শিপিং লাইনগুলোকে। যদিও বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ আমদানি–রপ্তানি দিয়ে এই সেবা ধরে রাখা যাবে কি না, তা নিয়ে এখনই নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না।
এ বিষয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ও অর্থনীতিবিদ মইনুল ইসলাম বলেন, ভারতের তাজপুর কিংবা মিয়ানমারের কিয়াউকফু গভীর সমুদ্রবন্দর চালু হলেও সুবিধার দিক থেকে মাতারবাড়ী এগিয়ে থাকবে। তবে শুধু নিজেদের পণ্য পরিবহনের চিন্তা করলে মাতারবাড়ী সমুদ্রবন্দর ব্যস্ততা খুব বাড়বে না। এ জন্য ভারতের সাত রাজ্য, নেপাল, ভুটান, মিয়ানমার ও চীনের একাংশের পণ্য পরিবহন নিশ্চিত করতে হবে।
থাইল্যান্ডভিত্তিক মিয়ানমারের সংবাদপত্র দ্য ইরাওয়ার্দি ৭ নভেম্বর এক প্রতিবেদনে বলেছে, কিয়াউকফু বন্দর চীন–মিয়ানমারের ১ হাজার ৭০০ কিলোমিটার দীর্ঘ অর্থনৈতিক করিডরে যুক্ত হবে।
এদিকে ভারত–বাংলাদেশ, মিয়ানমার–চীন—এই চার দেশের বিসিআইএম অর্থনৈতিক করিডর এখনো কার্যকর হয়নি। এই করিডর কার্যকর হলে মাতারবাড়ী বন্দরকে তার সঙ্গে যুক্ত করা যেত। সে ক্ষেত্রে চীন–মিয়ানমারের একাংশের পণ্য পরিবহনের সুযোগ থাকত। তাহলে কীভাবে চীনের ইউনান প্রদেশের পণ্য পরিবহনের সুবিধা পাবে বাংলাদেশ? জানতে চাইলে অর্থনীতিবিদ মইনুল ইসলাম বলেন, কিয়াউকফু অনেক দক্ষিণে। সে তুলনায় হিন্টারল্যান্ডের (স্থলপথের মাধ্যমে বন্দরের সংযোগ) মাধ্যমে মাতারবাড়ী দিয়ে যোগাযোগ কঠিন হবে না।
মাতারবাড়ী সমুদ্রবন্দর আঞ্চলিক বন্দর হওয়ার পথে সংশয় থাকলেও বাংলাদেশের প্রয়োজন মেটাতে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখবে বলে মনে করেন বন্দর ব্যবহারকারীরা। মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে চট্টগ্রাম বন্দর। এখন চট্টগ্রাম বন্দরের মূল টার্মিনালগুলোতে এক থেকে দুই হাজার কনটেইনারবাহী জাহাজ চলাচল করে। জাইকার সমীক্ষা অনুযায়ী, মাতারবাড়ীতে ৮ হাজার ২০০ একক কনটেইনার পরিবহনকারী জাহাজ চলাচল করতে পারবে।
সে ক্ষেত্রে বিশ্বের নানা দেশ থেকে বড় জাহাজে মাতারবাড়ী টার্মিনালে পণ্য আনা হবে। মাতারবাড়ী থেকে চট্টগ্রাম বন্দরের মূল টার্মিনাল, মোংলা, নির্মাণাধীন পায়রা বন্দরের টার্মিনাল ও নৌ টার্মিনালগুলোতে এসব পণ্য যাবে। একইভাবে এসব বন্দর থেকে কনটেইনার মাতারবাড়ীতে এনে ইউরোপ বা আমেরিকামুখী জাহাজে তুলে দেওয়া যাবে।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ ফ্রেইট ফরোয়ার্ডার্স অ্যাসোসিয়েশনের সহসভাপতি খায়রুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, কনটেইনারবাহী বড় জাহাজ ভিড়তে পারার সুবিধা মাতারবাড়ীকে দেশের অন্য সব বন্দর থেকে আলাদা করেছে। মাতারবাড়ী থেকে সরাসরি ইউরোপ–আমেরিকায় কনটেইনার জাহাজ পরিষেবা চালু হলে রপ্তানিমুখী পোশাকশিল্প বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় এগিয়ে যাবে। কারণ, প্রতিযোগী ভিয়েতনাম ও ভারতে গভীর সমুদ্রবন্দর থাকলেও বাংলাদেশে এত দিন ছিল না। সস্তা শ্রমের পাশাপাশি এখন এই গভীর সমুদ্রবন্দর পোশাকের মতো সব রপ্তানি খাতকে প্রতিযোগিতায় এগিয়ে দেবে।
মাতারবাড়ী বন্দর নির্মাণে নির্বাচিত ঠিকাদারের সঙ্গে চুক্তির পর নির্মাণকাজ শুরু হবে। কাগজে–কলমে গভীর সমুদ্রবন্দরের নির্মাণকাজ শুরু না হলেও মাতারবাড়ীতে গভীর সমুদ্রবন্দরের চ্যানেল ব্যবহার করে সাধারণ পণ্যবাহী জাহাজ চলাচল শুরু হয়ে গেছে ২০২০ সালের ডিসেম্বর থেকে। এখন পর্যন্ত বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাজে ব্যবহারের জন্য ১২৩টি জাহাজের পণ্য খালাস হয়েছে।
এর মধ্যে সাড়ে ১২ মিটার ড্রাফট (জাহাজের পানির নিচের অংশের দৈর্ঘ্য) ও ২২৯ মিটার লম্বা জাহাজও ভেড়ানো হয়েছে, যা বাংলাদেশের অন্য কোনো বন্দরে ভেড়ানোর সুবিধা বা নজির নেই। তবে বিদ্যুৎকেন্দ্রের নিজস্ব জেটি হওয়ায় অন্য প্রতিষ্ঠানের ব্যবহারের জন্য এখনো উন্মুক্ত করা হয়নি। এখন টার্মিনাল নির্মিত হলেই আনুষ্ঠানিকভাবে মাথা তুলবে বাংলাদেশের প্রথম গভীর সমুদ্রবন্দর।