Home » বিশ্বজুড়ে তীব্র খরার অশনিসঙ্কেত!

বিশ্বজুড়ে তীব্র খরার অশনিসঙ্কেত!

0 মন্তব্য 473 ভিউজ

পলাশ চন্দ্র দাস

তীব্র তাপপ্রবাহ এবং খরায় ইউরোপজুড়ে কয়েক সপ্তাহে বিভিন্ন নদী ও হ্রদের পানির স্তর নিচে নেমে গেছে। এছাড়া বিশ্বেরর সবচেয়ে বড় তিন অর্থনৈতিক শক্তি যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ এবং চীনের প্রবৃদ্ধি স্থবির হয়ে পড়ছে। বিশ্বজুড়ে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গতি ইতোমধ্যেই মন্থর হয়ে এসেছিল এবং দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতিতে নাভিশ্বাস উঠছিল জনগণের। তার মধ্যেই বিশ্ব অর্থনীতির ওপর এই নজিরবিহীন খরার আঘাত পরিস্থিতিকে আরও শোচনীয় করে তুলতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন অর্থনীতিবিদরা।

বছরের মাঝামাঝি কেনিয়া, ইথিওপিয়া এবং সোমালিয়ায় বৃষ্টিপাত না হওয়ায় ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা দুই কোটিতে পৌঁছে যায় এবং দুর্ভিক্ষের সতর্কতা আরও জরুরি হয়ে ওঠে। আগামী বর্ষাকালে বৃষ্টি না হলে ক্ষুধার তীব্রতা আরও বেড়ে যাবে।

খরায় ইউরোপে বিভিন্ন নদী ও হ্রদের পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় বিভিন্ন প্রাচীন সম্পদ দৃশ্যমান হচ্ছে। এতে কেউ কেউ অতীতের খরার স্মৃতি মনে করে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন, আবার কেউ কেউ প্রাগৈতিহাসিক সম্পদগুলো আবারও দেখতে পেয়ে আনন্দ বোধ করছেন।

আমেরিকার পশ্চিমাঞ্চলে নজিরবিহীন খরায় দেশটির বৃহত্তম জলাধারগুলো শুকিয়ে যাচ্ছে, যা ফেডারেল সরকারের পানি সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছে। কৃষকদের ফসলও নষ্ট করছে।

কয়েক সপ্তাহ ধরে চীনের দক্ষিণ-পশ্চিমের সিচুয়ান প্রদেশ থেকে ইয়াংসি নদীর অববাহিকার সাংহাই পর্যন্ত তীব্র গরম অনুভূত হওয়ার পর জাতীয় ‘ইয়েলো অ্যালার্ট’ জারি করে দেশটি। তীব্র দাবদাহের কবল থেকে ফসল রক্ষায় বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়ার পাশাপাশি চীন চলতি বছরের প্রথম জাতীয় খরা সতর্কতা জারি করেছে। খরায় আক্রান্ত প্রদেশগুলো বৃষ্টিপাতের ঘাটতি মোকাবিলায় ক্লাউড সিডিং বা কৃত্রিম বৃষ্টি ঘটানোর চেষ্টা করছে। হুবেইসহ কিছুসংখ্যক প্রদেশে রকেটের মাধ্যমে আকাশে রাসায়নিক পদার্থ ছিটানো হচ্ছে। ক্লাউড সিডিংয়ের মাধ্যমে মূলত আকাশে বৃষ্টির জন্য উপযুক্ত না হওয়া মেঘের ওপরে ড্রাই আইস বা সিলভার আয়োডাইডের মতো রাসায়নিক বিমান বা রকেটের মাধ্যমে ছিটানো হয়। এরপর মেঘ ঘনীভূত হয়ে বৃষ্টি হয়ে মাটিতে ঝরে। কিন্তু চীনে তাপদাহের মধ্যে কিছু কিছু এলাকায় মেঘের ছিটেফোঁটাও নেই। ফলে সেসব এলাকায় কৃত্রিম বৃষ্টিও ঝরানো যাচ্ছে না।

অক্সফোর্ড ইকোনমিক্সের গ্লোবাল ম্যাক্রো রিসার্চের পরিচালক বেন মে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন, এই খরার প্রভাবে দীর্ঘমেয়াদি সংকটে পড়বে বিশ্ব। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অর্থনৈতিক সংকট দেখা দিয়েছে। বহু দেশেই বেড়ে গেছে খাবারের দাম। তবে এসব দেশে সম্প্রতি এমন ঘটনা ঘটলেও হর্ন অব আফ্রিকার জন্য এটি কয়েক দশক থেকেই চলে আসছে। প্রতিদিনই বাড়ছে ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা। তাদের জন্য বেঁচে থাকাটাই যেন একটি অভিশাপে পরিণত হয়েছে।

জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) জানিয়েছে, খরাবিধ্বস্ত হর্ন অব আফ্রিকায় ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা ২২ মিলিয়নে (২ কোটি ২০ লাখ) পৌঁছেছে। কেনিয়া, সোমালিয়া এবং ইথিওপিয়া বছরের পর বছর পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত না হওয়ায় ৪০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ খরার মুখে পড়েছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চলে দুর্ভিক্ষের মতো অবস্থা হয়েছে।

পরপর চার বর্ষা ঋতুতে বৃষ্টি না হওয়ায় লাখ লাখ গবাদি পশুর মৃত্যু হয়েছে। হয়নি কোনো ফসলও। ১১ মিলিয়ন (১ কোটি ১০ লাখ) মানুষ খাদ্য ও পানির জন্য বাড়িঘর ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন। ডব্লিউএফপির নির্বাহী পরিচালক ডেভিড বিসলে বলেন, হর্ন অব আফ্রিকায় ব্যাপক দুর্ভিক্ষের হুমকি থেকে সবচেয়ে দুর্বল সম্প্রদায়গুলোকে রক্ষা করার জন্য বিশ্বের এখনই পদক্ষেপ নেওয়া দরকার।

২০২২ এর শুরুতে ডব্লিউএফপি সতর্ক করেছিল যে, তিনটি দেশে ১৩ মিলিয়ন (১ কোটি ৩০ লাখ) মানুষ অনাহারের সম্মুখীন হয়েছে। মানবিক কর্মীরা বলছেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্বজুড়ে মন্দা দেখা দেয়ায় হর্ন অব আফ্রিকার বিপর্যয় থেকে মনোযোগ সরে গেছে বিশ্বের। রাশিয়ার আগ্রাসনের ফলে বিশ্বব্যাপী খাদ্য ও জ্বালানির দাম বেড়েছে, যা সাহায্য বিতরণকে আরও ব্যয়বহুল করে তুলেছে।

চীনের কয়েক শহরের তাপমাত্রা ইতিমধ্যেই ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস (১০৪ ডিগ্রি ফারেনহাইট) অতিক্রম করেছে। গত ৬০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ তাপপ্রবাহের মুখোমুখি হচ্ছে চীন। যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার কিছু অংশ এই সপ্তাহে ৪০ ডিগ্রির বেশি তাপমাত্রা দেখতে পারে। এ বছর গ্রীষ্মের শুরুতেই প্রথমবারের মতো যুক্তরাজ্যে তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপরে উঠেছিল।

বিশ্ব অর্থনীতি আগে থেকেই চাপের মধ্যে ছিল। জ্বালানির দাম বেড়ে যাওয়ায় ইউরোপ আর্থিক মন্দার উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে। উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি এবং সুদের হার বাড়ানোয় যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক উন্নতি বাধাগ্রস্ত হবে। করোনা ঠেকাতে কঠোর লকডাউন এবং রিয়েল এস্টেট ব্যবসায় ধস নামায় চীনের প্রবৃদ্ধি কমে গেছে।

তীব্র খরার কারণে জার্মানির রাইন নদীর পানি ইতিমধ্যেই এতোটা নিচে নেমে গেছে যে, জাহাজ চলাচল বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। ফলে দেশটি আগামী শীতে বড় ধরনের সংকটে পড়বে। রাইন নদীর পানি কমে যাওয়ায় ২০১৮ খ্রিষ্টাব্দে জার্মানির অর্থনৈতিক উৎপাদন প্রায় ০ দশমিক ৩ শতাংশ কমে যায়। চলতি বছরের দ্বিতীয়ার্ধে জিডিপি কম পক্ষে ০ দশমিক ৫ শতাংশ কম হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে এবং জার্মানি আর্থিক মন্দার কবলে পড়তে পারে।

মার্কিন কৃষকদের প্রায় তিন চতুর্থাংশ বলেছেন, এই বছরের খরা তাদের ফসলের ক্ষতি করছে। ফল এবং বাদাম উৎপাদনের জন্য বিখ্যাত ক্যালিফোর্নিয়ার ৫০% কৃষক বলেছেন, খরার কারণে তাদের অনেক ফল গাছ এবং বহু ফসল নষ্ট হয়েছে, যা ভবিষ্যত রাজস্বের ওপর প্রভাব ফেলবে।

চীনের রাষ্ট্রায়ত্ত গণমাধ্যম সিসিটিভি জানায়, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় চংশিংয়ের ৩৪টি কাউন্টি জুড়ে বয়ে যাওয়া ৬৬টির মতো নদী শুকিয়ে গেছে। চলতি বছর চংশিংয়ে স্বাভাবিকের চেয়ে ৬০ শতাংশ কম বৃষ্টিপাত হয়েছে এবং বেশ কয়েকটি জেলায় মাটির আর্দ্রতা মারাত্মভাবে হ্রাস পেয়েছে। স্থানীয় সরকারের তথ্যের উদ্ধৃতি দিয়ে এখবর দিয়েছে সিসিটিভি। পার্বত্য এলাকায় ও বনগুলোতে দাবানল দেখা দেওয়ায় দমকলকর্মীরা উচ্চ সতর্ক অবস্থায় আছেন। অঞ্চলটিতে হিটস্ট্রোকের সংখ্যাও বেড়ে গেছে বলে।

ক্ষতির আশঙ্কার মধ্যে থাকা ফসল রক্ষার জন্য চংশিং কৃষি ব্যুরো বিশেষজ্ঞদের টিম গঠন করেছে এবং শরতে ফসল কাটার আগে ক্ষতি পূরণের জন্য রোপণ সম্প্রসারিত করেছে। দেশটির আবহাওয়া বিজ্ঞানীদের ধারণা, ২৬ অগাস্ট থেকে চলতি দাবদাহ হ্রাস পাওয়া শুরু হতে পারে। বাংলাদেশেও বিরূপ আবহাওয়ার কারণে অনাবৃষ্টি, খরা ও প্রচণ্ড দাবদাহ থেকে রক্ষা পেতে বিভিন্ন জেলায় নামাজ ও দোয়া এবং ব্যাঙের বিয়ে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। খরা ও অনাবৃষ্টিতে ফসলের জমিন ফেটে চৌচির হয়ে যাচ্ছে বিভিন্ন জেলা আমন চাষাবাদ হুমকির মুখে পড়েছে।

অবশ্য, বৃষ্টির পানির বিকল্প হিসেবে শ্যালো মেশিন কিংবা গভীর নলকূপের মাধ্যমে পানির সংকট মেটানোর চেষ্টা করলেও তা হবে অত্যন্ত ব্যয়বহুল। কোনো কোনো স্থানে বৃষ্টির বিকল্প পদ্ধতিতে সংকটটি মেটানোও হবে প্রায় অসম্ভব।

লেখক : সাংবাদিক

আরও পড়ুন

মতামত দিন


The reCAPTCHA verification period has expired. Please reload the page.

আমাদের সম্পর্কে

We’re a media company. We promise to tell you what’s new in the parts of modern life that matter. Lorem ipsum dolor sit amet, consectetur adipiscing elit. Ut elit tellus, luctus nec ullamcorper mattis, pulvinar dapibus leo. Sed consequat, leo eget bibendum Aa, augue velit.