ব্রিটেনের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি সময় ৭০ বছর সিংহাসনে ছিলেন রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ। তার মৃত্যুতে দেশটির নতুন রাজা এখন রানির বড় ছেলে তৃতীয় চার্লস। ক্ষমতার এ পালাবদলে বদলে যাবে দেশটির অনেক কিছু। এ পরিবর্তন কেবল জাতীয় সংগীতে সীমাবদ্ধ থাকছে না। আগামী কয়েক বছরে দেশটির বহুল ব্যবহৃত রয়্যাল স্টাম্প, কয়েন, ব্যাংক নোট- এমনকি পাসপোর্টেও পরিবর্তন আনতে হবে।
সেই পরিবর্তনের ছোঁয়া কোথায় কোথায় পড়তে পারে তারই বিশ্লেষণ করেছে বিবিসি, গার্ডিয়ানসহ একাধিক আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম। যেসব ক্ষেত্রে পরিবর্তন আসবে তা হলো-
যুক্তরাজ্যে ছড়িয়ে থাকা পুলিশ স্টেশনগুলো থেকে শুরু করে নৌবাহিনীর জাহাজে হাজার হাজার পতাকা বদলে ফেলতে হবে। ‘কুইন্স কালার্স’ পতাকা ব্যবহার করে দেশটির সামরিক রেজিমেন্ট, ফায়ার সার্ভিসের পতাকায় রয়েছে রানির আদ্যক্ষর, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা ও নিউজিল্যান্ডসহ যেসব দেশের রাষ্ট্রপ্রধান ছিলেন রানি এলিজাবেথ সেসব দেশের পতাকাকে ‘ই ফ্ল্যাগস’ বলা হয়, এসব পরিবর্তন করা হবে।
বদলাতে পারে রাজপ্রাসাদের পতাকাও। রানি এলিজাবেথ যে পতাকা ব্যবহার করতেন তাতে প্রতীকীভাবে স্কটল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড, ইংল্যান্ড এবং ওয়েলসকে তুলে ধরা হয়েছে। এটি তৈরি করা হয়েছিল ওয়েলস নিজেদের পতাকা পাওয়ার আগেই। ১৯৫৯ সালে ওয়েলস নিজেদের পতাকা পায়। এতে পরিবর্তন আনতে পারেন নতুন রাজা।
জাতীয় সংগীত
১৯৫২ সাল থেকে যে জাতীয় সংগীত ব্রিটিশরা গেয়ে আসছিলেন, তা বদলে যাবে। এখন থেকে ‘গড সেইভ দ্য কুইন’ এর বদলে ‘গড সেইভ দ্য কিং’ গাইবে সবাই। নিউজিল্যান্ডেরও জাতীয় সংগীত এবং অস্ট্রেলিয়া ও কানাডার রাজকীয় সংগীতেও একই পরিবর্তন আনতে হবে। কুইনের বদলে কিং ছাড়া জাতীয় সংগীতের মূল কথাগুলো একই থাকবে।
ব্রিটিশ রাজ সিংহাসনে যিনি থাকেন, তার ওপর নির্ভর করেই জাতীয় সংগীতের ভাষায় ওই পরিবর্তন হয়। কোনো আইনি বাধা না থাকায় তাৎক্ষণিকভাবে ভাষার ওই পরিবর্তন করা যায়। আনুষ্ঠানিকভাবে চার্লসকে রাজা ঘোষণার পর সেন্ট জেমস প্যালেসের বারান্দা থেকে একটি সর্বজনীন ঘোষণাও আসবে, সেখানে বলা হবে- ‘ঈশ্বর রাজাকে রক্ষা করুন’। তারপরই তা একসঙ্গে গাওয়া হবে।
ব্যাংক নোট ও মুদ্রা
বিশ্বে ছড়িয়ে থাকা প্রায় ৪.৫ বিলিয়ন ব্রিটিশ পাউন্ড স্টার্লিং ব্যাংক নোটে রানি এলিজাবেথের মুখ ছাপা রয়েছে। এগুলোর মূল্যমান ৮০ বিলিয়ন ব্রিটিশ পাউন্ড। নতুন রাজার ছবিযুক্ত ব্যাংক নোট দিয়ে এগুলো স্থলাভিষিক্ত করতে অন্তত দুই বছর সময় লাগতে পারে। সর্বশেষ ৫০ পাউন্ডের সিনথেটিক নোট ছাপার প্রক্রিয়ার সম্পন্ন হতে সময় লেগেছিল ১৬ মাস।
কানাডার ২০ ডলারের নোট, নিউজিল্যান্ডের মুদ্রায় রানির ছবি রয়েছে। এ ছাড়া ইস্টার্ন ক্যারিবিয়ান কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ইস্যু করা সব মুদ্রা ও নোটে রয়েছে রানির ছবি। কমনওয়েলথভুক্ত কয়েকটি দেশের মুদ্রাতেও রয়েছে রানির ছবি। ইতিহাসের ধারা মেনে চললে মুদ্রায় পরিবর্তন আসবে ধীরগতিতে।
ডাকবাক্স ও ডাকটিকিট
রয়্যাল মেইলের ডাকবাক্সগুলোতে রানি এলিজাবেথের রাজকীয় সংকেত সংবলিত প্রতীক (সাইফার) রয়েছে। এই প্রতীক বদলে ফেলা হতে পারে। অবশ্য মৃত্যুর ৭০ বছর পরও রাজা ষষ্ঠ জর্জের কিছু সাইফার এখনো ব্যবহৃত হয়। ডাকটিকিটে পরিবর্তন আনবে ডাকঘর। নতুন ডাকটিকিটে রাজার ছবি ব্যবহার করা হবে।
রাজকীয় সিল
ইংল্যান্ডে ‘টমেটো কেচাপ’ থেকে শুরু করে খাদ্যেশস্যের প্যাকেটেও অনেক সময় রয়্যাল সাইফার দেখা যায়। সেখানে লেখা থাকে, ‘বাই দ্য অ্যাপয়েন্টমেন্ট টু হার ম্যাজেস্টি দ্য কুইন’। এর অর্থ হলো, ওইসব পণ্য রাজ পরিবারের অনুমোদিত। এসব পণ্য রাজপরিবারেও সরবরাহ করা হয়। বর্তমানে প্রায় ৮০০ কোম্পানির অন্তত ৯০০ পণ্যে এ ধরনের সাইফার দেখা যায়। রীতি অনুযায়ী, যখন অনুমোদনকারীর মৃত্যু হয়, তখন কোম্পানিগুলো দুই বছরের সময় পায় সেই সাইফার ব্যবহারের। ব্যতিক্রম হিসেবে রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের মায়ের মৃত্যুর পর তা পাঁচ বছর ছিল।
বদলাবে পাসপোর্ট
রানির মৃত্যুতে ব্রিটিশ পাসপোর্টেও আসবে কিছু পরিবর্তন। সেখানে লেখা ‘টু হার ম্যাজেস্টি’ থেকে ’টু হিজ ম্যাজেস্টি’ শব্দটির পরিবর্তন আসবে। তবে পুরনো নকশায় রানির নামে জারি করা সব ধরনের পাসপোর্টও ভ্রমণের জন্য বৈধ থাকবে। একই সঙ্গে পরিবর্তন আসবে ইংল্যান্ড ও ওয়েল্স পুলিশের হেলমেটে ব্যবহৃত রয়্যাল মনোগ্রামে। এতদিন সেটি ছিল রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের নামের সাইফার সম্বলিত, যেখানে ইটুআর লেখা রয়েছে। ‘কুইনস কাউন্সেল’ হবে ‘কিংস কাউন্সেল’।
প্রার্থনা
রানি এলিজাবেথ ছিলেন চার্চ অব ইংল্যান্ডের ‘ডিফেন্ডার অব দ্য ফেইথ অ্যান্ড সুপ্রিম গভর্নর’ (ধর্মের রক্ষাকারী ও সর্বোচ্চ গভর্নর)। ‘বুক অব কমন প্রেয়ার’-এ যে কথাগুলো আছে সেগুলোতে রানির কথা বলা হয়েছে। প্রার্থনায় বলা হয়, ‘তাকে আপনার পবিত্র আত্মার অনুগ্রহে পূর্ণ করুন, যাতে সে সর্বদা আপনার ইচ্ছার প্রতি ঝুঁকে থাকে এবং আপনার পথে চলতে পারে’।
নতুন রাজার জন্য প্রার্থনায় তাই পরিবর্তন আসবে। এটি আইন করে বা রাজ ডিক্রি জারির মাধ্যমে করা হতে পারে। সর্বশেষ রাজমাতার মৃত্যুর পর পরিবর্তন করা হয়েছিল। সাময়িক সময়ের জন্য যাজকরা প্রার্থনায় পরিবর্তন আনতে পারেন। ফলে রবিবারের প্রার্থনায় সাধারণভাবে যা বলা হয় তাতে নতুন রক্ষাকারীর নাম সহজে অন্তর্ভুক্ত করা যাবে।
রয়্যাল আর্মস
গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনের মধ্যে থাকবে রয়্যাল আর্মস। এতে একটি সিংহ ও ঢালের বিরুদ্ধে আক্রমণে উদ্যত ইউনিকর্ন রয়েছে। সরকারি চত্বর এবং স্টেশনারিতে এটি ব্যাপক ব্যবহার রয়েছে। এগুলোর পরিবর্তন ব্যয়বহুল। তবু এগুলোর পরিবর্তন করা প্রয়োজন হতে পারে।
রয়্যাল ওয়ারেন্ট
রয়্যাল ওয়ারেন্টেও আসবে পরিবর্তন। ত্রিনিদাদ ও টোবাগো থেকে শুরু সাসেস্কের ৬ শতাধিক বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান রয়্যাল ওয়ারেন্ট ব্যবহার করে। মূলত রাজপরিবারের পণ্য সরবরাহে নিয়োজিতদের ক্ষেত্রে এটি কাজে লাগে। রানির মৃত্যুতে এসব প্রতিষ্ঠানের চুক্তি বাতিল হতে পারে। অবশ্য নতুন রাজা চাইলে বহাল রাখতে পারেন। এতে অবশ্য সময় লাগতে পারে। প্রিন্স ফিলিপ মারা যাওয়ার পর তার সরবরাহকারীদের দুই বছর সময় দেওয়া হয়েছিল।
আনুগত্যের অঙ্গীকার
রাজমুকুটের প্রতি আনুগত্যের অঙ্গীকার ছাড়া ব্রিটিশ এমপিরা হাউজ অব কমন্স, বিতর্কে অংশগ্রহণ, ভোট বা বেতন পান না। ১৯৫২ সাল থেকে আনুগত্যের অঙ্গীকারে ‘মহামান্য রানি এলিজাবেথ’-এর প্রতি আনুগত্যের কথা বলা হয়েছে। এখন নতুন এমপিরা নতুন রাজা ও তার উত্তরাধিকারীদের প্রতি আনুগত্য জানাবেন।
কমনওয়েলথ
কমনওয়েলথভুক্ত ১৪টি দেশ রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথকে স্বীকৃতি দিয়েছিল। অনেক ক্ষেত্রে সাংবিধানিকভাবে রানিকে রাষ্ট্রের প্রধান হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। এসব দেশের সংবিধান পরিবর্তন করে রানির স্থলে নতুন রাজাকে রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে ঘোষণা করতে হবে।
কমনওয়েলথ বিশেষজ্ঞদের মতে, জ্যামাইকার মতো দেশগুলোতে যেখানে শক্তিশালী গণতান্ত্রিক আন্দোলন রয়েছে সেখানে সংবিধান পরিবর্তনের জন্য গণভোটের আয়োজন করতে হবে। নতুন রাজার জন্য এটি একটি বিপজ্জনক রাজনৈতিক মুহূর্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
পাপুয়া নিউগিনি, সলোমন আইল্যান্ডস, তুভালু, অ্যান্টিগা ও বারমুডা, বাহামা, গ্রেনাডা, সেন্ট কিটস ও নেভিস, সেন্ট লুসিয়া ও সেন্ট ভিনসেন্ট যদি তাদের সংবিধান পরিবর্তন না করে তাহলে রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে থেকে যাবেন প্রয়াত রানি। আর সাংবিধানিক রাজতন্ত্র থাকা অস্ট্রেলিয়া, কানাডা ও নিউজিল্যান্ডে আইন রয়েছে, যাতে নতুন ব্রিটিশ রাজা স্বয়ংক্রিয়ভাবে রাষ্ট্রপ্রধান হয়ে যাবেন।