বাংলাদেশে চা বাগান প্রতিষ্ঠা পায় অষ্টাদশ শতকে। ব্রিটিশ ভারতবর্ষের ব্রহ্মপুত্র অববাহিকায় ইংরেজ শাসকরা চা চাষের পরিকল্পনা করে। অসমে চায়ের একটি পাতা আবিষ্কার করার পর দার্জিলিং, অসম, সিলেট ও চট্টগ্রাম অঞ্চলে চা বাগান প্রতিষ্ঠা করে। ১৮৫৪ সালে সিলেটের মালনিছড়ায় বাণিজ্যিক চা বাগান প্রতিষ্ঠা করা হয়। তিন বছর পর সেই চা বাগান থেকে বাণিজ্যিকভাবে চা উৎপাদন শুরু হয়। চা বাগানে প্রথমে যে নারী শ্রমিকরা কাজ করতেন তারা সিলেটের স্থানীয় ছিল না।
এসব নারী শ্রমিকদের ভারতের বিহার উড়িষ্যা, মাদ্রাজ নাগপুর, সাঁওতাল পরগনা মধ্য ও উত্তর প্রদেশ থেকে নিয়ে আসা হতো। তাদের বেশিরভাগ ছিল গরির, দুর্বল ও নিম্নবর্ণের হিন্দু সম্প্রদায়ের। দালালরা তাদের ভাল চাকরি ও উন্নত জীবনের লোভ দেখিয়ে নিয়ে আসলেও পরবর্তীতে তা পূরণ করত না। বাগান মালিকরা এই নারী শ্রমিকদের নিজেদের সম্পত্তি বলে মনে করত। মালিকরাই তাদের স্বাধীনতা নির্ধারণ করে বিভিন্ন বাগানে আনা-নেয়া করত।
এখানে এসে তারা সারা জীবনের জন্য বন্দী হয়ে পড়তেন। ব্রিটিশরা শুরুর দিকে এভাবে আনলেও পরে আর তাদের আনতে হয়নি। সন্তানরাও বংশ পরস্পরায় এভাবেই কর্মী হিসেবে চা বাগানে আজও কাজ করে যাচ্ছে। দেড়শ’ বছর পরেও তারা বাংলাদেশের মুসলমানদের সঙ্গে মিশে যেতে পারেনি। শিক্ষা, চাকরি সুযোগের অভাবে তারা চা বাগানের মধ্যেই আটকে রয়েছে। স্বাধীন দেশে এ যেন এক বন্দী দশা। চা বাগনে সবচেয়ে নারী শ্রমিকরাই বেশি পরিশ্রম করে। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এক অবর্ণনীয় কষ্টে চলে তাদের কাজ। কিন্তু দিন শেষে এই নারী শ্রমিকদের মজুরি ছিল মাত্র ১২০টাকা।
চা বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী ১৬৭টি চা বাগানে ৫ লক্ষাধিক চা শ্রমিকের স্থায়ী শ্রমিক প্রায় ১ লাখ। একজন শ্রমিকের মজুরির ওপর কমপক্ষে ৫/৬ জনের ভরণ পোষণ নির্ভর করে। এত অল্প মজুরিতে চরম কষ্টে দিনাতিপাত করে আসছে।
তার পরও থেমে থাকেনি তারা, তাদের হাড় ভাঙ্গা পরিশ্রমে বাংলাদেশ চা উৎপাদনে বিশে^ নবম স্থানে উঠে এসেছে। এমন কি করোনাকালীন সময়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে চা উৎপাদনে সক্রিয় ছিল এই নারী শ্রমিকরা। ২০২১ সালে ৯৬ দশমিক ৫০৬ মিলিয়ন কেজি চা উৎপাদন করে নতুন রেকর্ড সৃষ্টি করে।
বাংলাদেশে সিলেট হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার ও চট্টগ্রাম জেলার ১৬৭টি নিবন্ধিত চা বাগানে সোয়া লাখের বেশি শ্রমিক কাজ করে। এদের অধিকাংশই নারী। এ সব নারী শ্রমিক ১৯ কেজি চা পাতা তুললে ১২০ টাকা মজুরি পেত। এর বেশি হলে কেজি প্রতি ২ টাকা ৫০ পেত। যা দিয়ে তাদের সংসার চালানো খুব কঠিন হয়ে পড়ত। তবে বর্তমানে পাবে ১৭০ টাকা আর এর বেশি প্রতি কেজিতে ৪ টাকা করে পাবে।