নিকট অতীতে অপর দেশ থেকে বাংলাদেশে মর্টার ছোড়ার নজির নেই। এ কারণে বান্দরবান সীমান্ত নিয়ে ঢাকায় সৃষ্ট উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার বাস্তব কারণ আছে। তবে ‘যুদ্ধের সময়’ প্রতিদিনই ঘটনা পাল্টায়।
ঢাকায় যখন মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে একের পর এক তলব চলছে, ঠিক তখনই, ১৯ সেপ্টেম্বর আরাকান আর্মির মূল রাজনৈতিক সংগঠন ইউনাইটেড লিগ অব আরাকান (ইউএলএ) অনলাইন প্রেস কনফারেন্স করে নাটকীয় এক ঘোষণা দিল। তারা বলছে, আরাকানের যেকোনো বিষয়ে বৈশ্বিক সবাইকে তাদের সঙ্গে বোঝাপড়ায় আসতে হবে।
সরাসরি বাংলাদেশের নাম ধরে তারা বলেছে, রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠাতে হলে বাংলাদেশ সরকারকে ইউএলএ এবং আরাকান আর্মিকে স্বীকৃতি দিয়ে আলোচনায় বসতে হবে। সে রকম হলে ইউএলএ নিজে থেকে পারস্পরিক সম্মতির ভিত্তিতে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবর্তনের একটা রোডম্যাপ প্রকাশ করবে।
ইউএলএর গুরুত্বপূর্ণ নেতা খইং থু খা সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেছেন। আরাকানের সাংবাদিক ক্য ছেন হ্লাইনসহ বহু মানুষ মিয়ানমারের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সেটা প্রকাশ করেছেন।
ঢাকায় আরাকান আর্মির এই গুরুত্বপূর্ণ বার্তা যে প্রচারমাধ্যমে গুরুত্ব পায়নি, সেটা বিস্ময়কর। অথচ এ ঘোষণায় স্পষ্ট হয়ে গেল, বাংলাদেশের পক্ষে কেবল মিয়ানমারের সেনা জান্তা তাতমা-দৌর সঙ্গে আলোচনা করে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানো আর সম্ভব নয়। নিঃসন্দেহে দক্ষিণ সীমান্তে এটা এক পালাবদল।
ইউএলএর ১৯ সেপ্টেম্বরের ঘোষণায় ভারতের জন্যও উদ্বেগের কারণ। আরাকানে রয়েছে ‘কালাদান প্রজেক্ট’ নামে তাদের বিপুল বিনিয়োগ। তবে মিয়ানমার নিয়ে বাংলাদেশ-ভারতের চেয়েও বৈশ্বিক উদ্বেগ অনেক বেশি এ মুহূর্তে। সেখানকার গৃহযুদ্ধ কেবল আর এক-দুই প্রদেশ বা বিভাগে সীমিত নেই; সর্বগ্রাসী সামরিক সংঘাত এবং ভেঙে পড়া অর্থনীতি নিয়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার জন্য বাড়তি ভয়ের কারণ হয়ে উঠছে ৬ লাখ ৭৮ হাজার বর্গকিলোমিটারের এই ভূখণ্ড।
বিশ্বের অন্যতম মাদক উৎপাদনকেন্দ্র এ দেশ। সঙ্গে রয়েছে দেশজুড়ে হালকা ও মাঝারি অস্ত্রের ব্যাপকতা। এসবের অভিভাবক হিসেবে আছে ক্ষমতাবিলাসী জেনারেল-দল এবং অগণিত গেরিলা বাহিনী। সব মিলে মিয়ানমার চারপাশের দেশগুলোর জন্য ধারণাতীত দুর্যোগ ঘটিয়ে ফেলতে পারে কি না, তা–ও ভাবার সময় হয়েছে এখন।
জাতিসংঘ, ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপসহ বহু সংস্থা গত বছরই বলে রেখেছিল, মিয়ানমার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রথম ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হওয়ার বিশ্বাসযোগ্য ঝুঁকিতে আছে। ঘরের কাছের এ রকম খবরাখবর বাংলাদেশের জন্য সুনির্দিষ্ট প্রস্তুতি দাবি করছে।
জান্তার নিয়ন্ত্রণ কমছে বিভিন্ন এলাকায়
নির্মমতায় মিয়ানমার সশস্ত্র বাহিনীর রেকর্ড ভালো নয়। সেসব জেনেই ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে অনেকে ধারণা করেছিলেন, ১৯৬২ ও ১৯৮৮ সালের সামরিক অভ্যুত্থানের মতো এবারের অভ্যুত্থানকারীরাও সহজে পরিস্থিতি সামাল দিয়ে ফেলবে। পরিকল্পনামতো তা হয়নি, হচ্ছে না।
নির্মমতার কমতি না থাকলেও বামার তরুণ-তরুণীরা এবার জেনারেলদের নির্দেশমতো ঘরে আটকে থাকছে না। এই পরিস্থিতির সুযোগ নিতে চাইছে আঞ্চলিক স্বাধীনতাকামীরাও। ইয়াঙ্গুন ও মানদালের মতো বড় শহরগুলোয় পরিস্থিতি প্রায় নিয়ন্ত্রণে থাকলেও দূরের অঞ্চলে সামরিক শাসনবিরোধী জাতীয় ঐক্য সরকারের (এনইউজি) কর্মীরা বেশ সক্রিয়। তাদের অধীন পিপলস ডিফেন্স ফোর্স (পিডিএফ) নামে ছোট ছোট গেরিলা দল গড়ে উঠছে বহু টাউনশিপে।
বাংলাদেশে উপজেলা বলতে যা বোঝায়, মিয়ানামারে সেটাই ‘টাউনশিপ’। এ রকম টাউনশিপ আছে তিন শতাধিক। এর তিন ভাগের এক ভাগে কেবল তাতমা-দৌর নিয়ন্ত্রণ আছে বলে দাবি মিয়ানমার বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের আন্তর্জাতিক সংস্থা ‘স্পেশাল অ্যাডভাইজারি কাউন্সিল ফর মিয়ানমার’–এর। ৫ সেপ্টেম্বর তাদের প্রকাশিত এক সরেজমিন প্রতিবেদনে দাবি করার হয়েছে, মূলত নগর এলাকার ৭২টি টাউনশিপে সামরিক জান্তার ‘কার্যকর দখল’ আছে।
এ রকম বৈরী পরিস্থিতিতে বহুমুখী কৌশল নিয়েছেন ‘সিনিয়র জেনারেল’ মিন অং হ্লাই। নিয়মিত কর্মসূচি হিসেবে আছে বিরুদ্ধবাদীদের সমর্থক গ্রামগুলো জ্বালিয়ে দেওয়া এবং কোনো ধরনের সশস্ত্র প্রতিরোধের চিহ্ন পেলে পাইকারি খুন।
দ্বিতীয় কৌশল হিসেবে এলাকায় এলাকায় গণতন্ত্রপন্থীদের বিরুদ্ধে নানান ধরনের আধা সামরিক বাহিনী গড়ে তোলা হচ্ছে। রাজধানী নেপিডোর চারদিকে এ রকম উদ্যোগ বেশ চোখে পড়ে। প্রতিটি পরিবার থেকে একজনকে মিলিশিয়ায় যোগ দেওয়ার নির্দেশ আছে। মিলিশিয়া গড়ার কাজে জান্তার সমর্থক ভিক্ষুদেরও যুক্ত করা হচ্ছে।
এ রকম কর্মসূচির কারণে পারস্পরিক সন্দেহ-অবিশ্বাসে জনসমাজ ভেতর থেকে ভেঙে পড়ছে। বামারদের এই আন্তবিবাদ অবামারদের জন্য দেশজুড়ে কিছুটা সুবিধাজনক হয়েছে। প্রায় ৩২ শতাংশ মানুষ এখানে অবামার জাতিগোষ্ঠীর। তীব্র নজরদারির মাধ্যমে ইয়াঙ্গুনকে অনেকটাই শান্ত রাখা গেলেও ২২ আগস্ট কুখ্যাত ইনসেইন কারাগারে গ্রেনেড ছুড়েছিল অজ্ঞাত গেরিলারা।
ইনসেইনসহ বিভিন্ন বন্দিশালায় জান্তার হাতে আটকাবস্থায় গত বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত ৭৩ জন রাজনৈতিক বন্দী মারা গেছেন বলে ১৩ সেপ্টেম্বর দাবি করেছে মানবাধিকার সংস্থা ‘হিউম্যান রাইটস ওয়াচ’। এই সংখ্যা বিভিন্ন স্থানে তাৎক্ষণিকভাবে খুন হওয়া ৬৯০ জন প্রতিবাদী মানুষের অতিরিক্ত। এর বাইরে জান্তার হাতে প্রায় আট হাজার মানুষ গ্রেপ্তারের তথ্য জানিয়েছিলেন মিয়ানমার বিষয়ে জাতিসংঘের বিশেষ কর্মকর্তা টমাস অ্যান্ড্রু গত অক্টোবর মাসে।
আঞ্চলিক গেরিলা দলগুলো পারস্পরিক সহায়তা বাড়াচ্ছে
সামরিক বিবেচনায় এ সপ্তাহে মিয়ানমারের সবচেয়ে নাটকীয় ঘটনা—আরাকান আর্মির দ্বিতীয় কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার ঞো থোয়াই অং শান প্রদেশে ওয়া আর্মির উপপ্রধান বাও ওই চাঙের সঙ্গে বসেছিলেন। মিয়ানমার বিষয়ে যাঁরা বিস্তারিত জানেন, তাঁরা বুঝবেন, এ রকম বৈঠক সামরিক জান্তার জন্য খারাপ বার্তা। ওয়া আর্মি সবচেয়ে বড় এবং সুসজ্জিত গেরিলা দল।
আরাকানে ব্যাপক গৃহযুদ্ধের মুখে ওয়াদের কাছে আরাকান আর্মি উন্নত অস্ত্রপাতি চাইছে। বিশেষ করে বিমানবিধ্বংসী অস্ত্র খুঁজছে রাখাইনরা। ওয়াদের সঙ্গে আরাকান আর্মির বৈঠক সফল হলে আরাকানের পরিস্থিতি আরও পাল্টে যেতে পারে। ইতিমধ্যে সেখানে স্থলযুদ্ধে তাতমা-দৌ পিছু হটছে। বাংলাদেশ সীমান্তের কাছে বেশ কয়টি বড় চৌকিও হারিয়েছে তারা।
রাশিয়া থেকে পাওয়া জঙ্গি বিমানগুলো দিয়ে নির্বিচার বোমাবর্ষণ করে বামার বাহিনী আরাকানে কর্তৃত্ব ধরে রাখতে চাইছে। ওয়া আর্মির কাছ থেকে সহায়তা পেলে আরাকান আর্মির পক্ষে সেনাবাহিনীর আক্রমণ মোকাবিলা সহজ হবে।
আবার ওয়া আর্মি টাঙ আর্মিসহ আরও কয়েকটি আঞ্চলিক গেরিলা দলের সঙ্গেও বসেছিল এ সপ্তাহে। এসব দেখে অনুমান করা হচ্ছে, তাতমা-দৌর দুর্বলতার মুহূর্তে প্রদেশভিত্তিক প্রতিটি গেরিলা দল প্রভাবের পরিসর নতুন করে বাড়িয়ে নিতে তৎপর।
আসছে সহিংসতার নতুন তরঙ্গ
দেশের ভেতরকার অবস্থার মতোই মিয়ানমারের সামরিক সরকার আন্তর্জাতিক পরিসরেও ধীরলয়ে কোণঠাসা অবস্থায় পড়ছে। প্রকাশ্যে চীন ও রাশিয়াই কেবল তাদের মদদ দিচ্ছে। তবে চীন ও রাশিয়া থেকে অস্ত্র কেনার ক্ষেত্রে জান্তার বড় সমস্যা দেশের অর্থনীতি।
বিশ্বব্যাংকের গত ২১ জুলাইয়ের ঘোষণায় দেখা যায়, ২০২২ সালে জিডিপির প্রবৃদ্ধি আগের বছরের চেয়ে ৩ ভাগ বাড়ার সম্ভাবনা থাকলেও ২০১৯ সালের অবস্থার চেয়ে সেটা এখনো অনেক নিচে। ডলারের বিপরীতে স্থানীয় মুদ্রা চাটের দাম অভ্যুত্থানের আগের চেয়ে প্রায় তিন ভাগের এক ভাগ হয়ে গেছে। বৈদেশিক মুদ্রার ভান্ডার বাঁচাতে ইতিমধ্যে আমদানিতে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়েছে।
জেনারেল মিন অং হ্লাইয়ের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার জন্য এসব কিছুটা বাধাস্বরূপ। আগামী বছর দেশে নতুন নির্বাচন দিতে চান তিনি, যাতে তাঁর সরকারে একটা বেসামরিক ভাব আসে। কিন্তু রাশিয়া ও চীন ছাড়া, এমনকি আসিয়ানভুক্ত কম দেশেও এ রকম নির্বাচন গ্রহণযোগ্যতা পাবে।
আর ‘নির্বাচনের উপযোগী পরিবেশ’ তৈরির নামে দেশটিতে ভবিষ্যতে সামরিক দমনপীড়ন আরও বাড়তে পারে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গেরিলাদের বার্তা বিনিময় ঠেকাতে শিগগিরই ফেসবুক বন্ধ করা হবে বলে শোনা যাচ্ছে। তবে নিজের পক্ষের মিলিশিয়াদের যোগাযোগের মধ্যে রাখতে নিজস্ব একটা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমও চালু করবে জান্তা।
অন্যদিকে সম্ভাব্য নির্বাচন প্রতিরোধের জন্য পিডিএফ গেরিলারাও সর্বোচ্চ সবকিছু করবে। উভয় পক্ষের তরফ থেকে এ রকম তুমুল সহিংসতার শঙ্কায় আন্তর্জাতিক উদ্বেগ ক্রমে বাড়ছে। তবে বিশ্বের যেকোনো দেশের চেয়ে মিয়ানমার নিয়ে বাংলাদেশের দুর্ভাবনা অবশ্যই বেশি কিছু।
১১ লাখ শরণার্থী নিয়ে আরাকান আর্মির নতুন ঘোষণা, সীমান্তের সামরিক উসকানি কিংবা পুরোনো সমস্যা হিসেবে মাদকের ছদ্ম আগ্রাসনের বাইরে নতুন ভীতি ছড়াচ্ছে গৃহযুদ্ধের ছড়িয়ে পড়া আগুন।
এই গৃহযুদ্ধ মিয়ানমারকে ছিন্নভিন্ন করে ফেলতে পারে। বাংলাদেশ ২০১৭ সালে মানুষের ঢেউ সামলাতে পারেনি। ভবিষ্যতে তাকে হয়তো বহুভাবে বিভক্ত মিয়ানমার থেকে অস্ত্রপাতির ঢেউও সামলাতে হবে।