Home » পথের শেষ কোথায় ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়া ও পাশ্চাত্য

পথের শেষ কোথায় ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়া ও পাশ্চাত্য

0 মন্তব্য 322 ভিউজ

১. এক অন্তহীন ট্র্যাজেডি
২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২২ সমস্ত জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে পুতিনের সেনাবাহিনী ইউক্রেনের সীমান্ত লঙ্ঘন করে ঢুকে পড়ল ভেতরে। এর পরপরই ইউক্রেন ছেড়ে চলে গেলেন সোফিয়া রোতারু, আর রাশিয়া ছাড়লেন আলা পুগাচেভা। কে ভালো গান করে- এ নিয়ে সবসময়ই তর্ক হতো সত্তর-আশির দশকের সোভিয়েত ইউনিয়নে। সোফিয়া গাইতেন মূলত লোকজ ধারার সংগীত- আধুনিক বাদ্যযন্ত্রের সহযোগে। আলা গাইতেন মূলত পপ গান। একসময় রসিকতা করা হতো যে, মহাশক্তিধর ব্রেজনেভ হচ্ছেন ‘আলা পুগাচেভা যুগের একজন মাইনর পলিটিশিয়ান’। সোফিয়া রোতারু ও আলা পুগাচেভার মধ্যে একধরনের নীরব প্রতিযোগিতা ছিল যেমন, তেমনি ছিল প্রগাঢ় বন্ধুত্ব। এটা ভাবতে কষ্ট লাগে যে আলা পুগাচেভার রুশ বাহিনী সোফিয়া রোতারুর ইউক্রেনকে আক্রমণ করে বসেছে। এটা একটা উপমা মাত্র। বাস্তবে কী দেখি আমরা? সোভিয়েত ইউনিয়নের ভূগোল-ইতিহাসে ইউক্রেন ও রাশিয়ার মধ্যে কখনও বিশেষ ফারাক করা হতো না। রাশিয়া, ইউক্রেন ও বেলারুশিয়া- এই তিনটি সত্তা মিলে গড়ে উঠেছিল ‘কিয়েভস্কি রুশ’ বা ‘এনসিয়েন্ট রুশ-এর জাতি-রাষ্ট্রের আদি কাঠামো। জাতিগত-নৃতাত্ত্বিক দিক থেকে এরা খুব কাছাকাছি ভুবনের; অনেক রুশ বা ইউক্রেনীয় পরিবারই পরস্পরের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ। প্রায় সব পরিবারই মিশ্র পরিবার : মা-বাবা, দাদা-দাদি, নানা-নানি, চাচাতো-খালাতো ভাই-বোন ঘাঁটলে পাওয়া যাবে একজন ইউক্রেনীয় বা একজন রুশি ব্যক্তি। একই আলো-হাওয়ার, একই ভূপ্রকৃতির, একই সংস্কৃতির, একই মানস-ভুবনের বাসিন্দা এই দুই জাতির মানুষেরা। ২০২১ সালের ১২ জুলাইয়ের একটি প্রবন্ধে পুতিন অবশ্য দাবি করেছিলেন, ইউক্রেনীয় ও রুশিরা আসলে একই জনগোষ্ঠীরই সদস্য :Russians and Ukrainians were one peopleÑ a single whole। এদের মধ্যে তাই দেয়াল তোলা যায় না বা শুধু কৃত্রিম দেয়ালই তোলা যায়। তাদের প্রায় একই ভাষা ‘old Russian’), একই বাচনভঙ্গি, একই জীবনযাপন পদ্ধতি, একই ধর্মজীবন (অর্থোডক্স চার্চ)। পুতিন সেই লেখায় অভিযোগ করেছিলেন :‘the wall that has emerged in recent years between Russia and Ukraine, between the parts of what is essentially the same historical and spiritual space, to my mind is our great common misfortune and tragedy. তাহলে এদের মধ্যে দেয়াল তুলল কে? পুতিনের মতে, এর জন্য দায়ী ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ের কিছু ভুলভ্রান্তি। তবে আধুনিক বিভক্তির মূলে রয়েছে পাশ্চাত্যের প্ররোচনা।

‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’-এর প্রাচীন ঔপনিবেশিক নীতি। ইউক্রেন ও রাশিয়ার মধ্যে চিরস্থায়ী ফাটল সৃষ্টি করা গেলে পাশ্চাত্যের বড় ধরনের বিজয় অর্জিত হয়। যারা উৎসাহী তারা পুতিনের লেখাটি (On the Historical Unity of Russians and Ukrainians) পড়ে দেখতে পারেন। সোভিয়েত পর্বের ৭০ বছরে ইউক্রেন ও রাশিয়ার সম্পর্ক আরও গভীর হয়। এটা বলাই যথেষ্ট যে, সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে ইউক্রেনীয় নেতারা কোনো বাধা না পেয়েই সর্বোচ্চ পর্যায়ে অধিষ্ঠান করেছেন। নিকিতা ক্রুশ্চেভ ও লিওনিদ ব্র্রেজনেভ দু’জনেই ছিলেন ইউক্রেনীয় জাতিসত্তার (দু’জনে মিলে তাঁরা ৩০ বছর সোভিয়েত ইউনিয়নের সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর নেতা হিসেবে শাসন করেছিলেন)। এর আগে জর্জীয় স্তালিন এক দীর্ঘ সময় ধরে সোভিয়েত ইউনিয়ন শাসন করেছেন। কে রুশ, কে ইউক্রেনীয়, আর কে জর্জীয় বা আর্মেনীয়- এটা বিবেচ্য বিষয় ছিল না বহুজাতিক সোভিয়েত ইউনিয়নে। আমার ছাত্রজীবনের ৯ বছরে কখনও মস্কো বনাম কিয়েভ, বা রুশি বনাম ইউক্রেনীয় জাতিসত্তা নিয়ে কোনো বিরূপ মন্তব্য শুনিনি মস্কো স্টেট ইউনিভার্সিটি অথবা একাডেমি অব সায়েন্সেসের করিডোরে। বেলারুশ, ইউক্রেন ও রুশ জাতিসত্তার মধ্যকার পার্থক্য ছিল একই মহাজাতির মধ্যকার স্বাভাবিক অঞ্চলগত তারতম্যের বিষয়। একে কখনোই ফাটল বলে মনে হয়নি। যারা মিখাইল বুলগাকভের ‘হোয়াইট গার্ডস’ পড়েছেন, তারাই জানবেন বিপ্লবোত্তর সোভিয়েত ইউনিয়নে রুশি ও ইউক্রেনীয়রা কীভাবে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করেছে বহিঃশত্রুর বিরুদ্ধে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে দুই জাতিসত্তা নিজ নিজ অভিমান ভুলে গিয়ে মিলেমিশে লড়াই করেছে বহিঃ আগ্রাসনের বিরুদ্ধে। ওয়েলস্‌, স্কটল্যান্ড ও ইংল্যান্ডের মধ্যে যে পার্থক্য; ততটাও প্রভেদ নেই একজন রুশি এবং একজন ইউক্রেনীয়র মধ্যে। তাহলে গণ্ডগোল বাধল কেন? যুদ্ধ শুরু হলো কেন? আর শুরুই যদি হলো দ্রুত শান্তিপূর্ণ সংলাপের দিকে সেটি গড়াল না কেন? ইউরোপের বুকে ইউক্রেন হচ্ছে দ্বিতীয় বৃহত্তম রাষ্ট্র- কী ভৌগোলিক বিচারে, কী জনসংখ্যার দিক থেকে।

রাশিয়া দুই নিরিখেই প্রথম। এই দুই রাষ্ট্রের মধ্যে চলমান রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পরিণাম সমগ্র ইউরোপের জন্যই আশঙ্কাজনক হতে পারে। আশি লাখের ওপরে উদ্বাস্তু এরই মধ্যে তাদের স্বদেশ ইউক্রেন থেকে ইউরোপে আশ্রয় নিয়েছে; অভ্যন্তরীণভাবে ঘরছাড়া আরও দশ লাখের ওপরে মানুষ। জেনারেল শোইগু বলেছেন, ৬০ হাজার ইউক্রেনীয় সেনা এরই মধ্যে প্রাণ হারিয়েছেন। আজ অবধি যে ধ্বংসযজ্ঞ হয়েছে তাতে করে পুনর্গঠনের জন্য ইউক্রেনের দরকার হবে ৬০০ বিলিয়ন ডলার। এটি জেলেনস্কি সরকারের হিসাব। এই বিচারে আগামী ছয় মাসে এ সংখ্যা ১২০০ বিলিয়ন ডলার ছাড়াতে পারে। বিশ্বব্যাংকের হিসাব মতে, ২০২২ সালে ইউক্রেনের মোট জিডিপি শতকরা ৫০ ভাগ হ্রাস পাবে। তুলনার জন্য বলছি, এ পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে ইউক্রেন পেয়েছে অস্ত্র-সাহায্য মিলিয়ে মাত্র ১৫ বিলিয়ন ডলার। এসব বিচার করলে এই আর্থিক ক্ষতি আগামী ১০ বছরেও পূরণ হবার নয়। ইউরোপে যে পথে চলছে ইউক্রেন যুদ্ধ, সেই পথের শেষ কোথায়? রাশিয়া বা ইউরোপ ক্ষতিগ্রস্ত হবে কতটা, সে প্রশ্ন বাদ দিলেও এটা নিশ্চিত যে ইউক্রেন ধ্বংসস্তূপে পরিণত হতে চলেছে।

২. ইউক্রেন নিয়ে ন্যারেটিভ যুদ্ধ
পুতিন যা-ই বলুন না কেন, ইতিহাসের কোনো এক সময়ে রুশি ও ইউক্রেনীয়রা এক ‘মহাজাতির অংশ’ ছিল, এটা পরবর্তী সময়ে তাদের মধ্যে বিরোধ না হওয়ার বিরুদ্ধে যথেষ্ট গ্যারান্টি দিতে পারে না। ইতিহাসের একত্ব সমসাময়িক (জাতীয়তাবাদী) বিরুদ্ধতাকে রুখতে পারে না অনেক ক্ষেত্রেই। বিরোধ লাগার জন্য নিকট অতীতে বা সমসাময়িক কালের যে কোনো হঠকারী পদক্ষেপই যথেষ্ট। রাষ্ট্রে-রাষ্ট্রে শান্তি প্রতিনিয়ত পুনরুৎপাদিত করতে হয়। ভাইয়ে-ভাইয়ে যখন যুদ্ধ বাধে, তখন তা অন্য সব যুদ্ধের তুলনায় আরও রক্তক্ষয়ী, আরও নির্মম হয়ে ওঠে। প্রাত্যহিক জীবনে এটা আমরা দেখি, এপিকেরও এটাই প্রধান বার্তা। কুরু ও পাণ্ডবের মধ্যকার লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে মহাভারতের ধ্বংস যখন অনিবার্য হয়ে উঠল, রক্তের সম্পর্ক তাতে প্রতিরোধ হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। কুরু ও পাণ্ডব পক্ষ তো রক্তসম্পর্কে আত্মীয় (চাচাতো ভাই) ছিলেন। তাতে করে তো মহাযুদ্ধ থামানো যায়নি। সেখানে তো তবু অর্জুনকে যুদ্ধের পূর্বাহেপ্ত হঠাৎ বিষাদগ্রস্ত হতে দেখি। আজকের রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধের শুরুতে তো কোনো পক্ষকেই- না পুতিন, না জেলেনস্কি- কাউকেই ক্ষণকালের জন্য হলেও অর্জুন-বিষাদে আক্রান্ত হতে দেখলাম না।

সুধীন্দ্রনাথের কবিতার মতো এই ধ্বংসযজ্ঞে সমান অংশীদার হলেন দুই যুধ্যমান পক্ষই। ভুল বললাম- এর মধ্যে তৃতীয় আরেক পক্ষও রয়েছেন। সেটি হচ্ছে- সমবেতভাবে আমরা যাকে বলি ‘কালেক্টিভ ওয়েস্ট’ বা পাশ্চাত্য। বস্তুত এই যুদ্ধের তারাই পরম পক্ষ। সম্প্রতি ভিয়েতনামের একজন কূটনীতিক-উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ আমাকে বলেছেন, জেলেনস্কি চাইলেও শান্তির সংলাপে যাওয়ার ‘এজেন্সি’ বা স্ব-সামর্থ্য তার নেই। পাশ্চাত্যকে (বিশেষত যুক্তরাষ্ট্রকে) এড়িয়ে রাশিয়ার সাথে কোনো শান্তির সন্ধিতে যেতে চাইলে তিনি নিশ্চিতভাবেই ক্ষমতা হারাবেন। তার নিকটবলয়ের থেকেই কেউ এই কাজটি করে দেবেন পাশ্চাত্যের হয়ে। পাশ্চাত্যঘেঁষা মূলধারার মিডিয়া-সংবাদপত্র অন্য কথা বললেও এটাই সত্য বলে প্রতিভাত হচ্ছে। শান্তির হাত-পা বাঁধা। কেননা, যুদ্ধ চলছে বহিরঙ্গে ও অন্তরঙ্গে। বহিরঙ্গে এটা রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যকার যুদ্ধ; কিন্ত অন্তরঙ্গে এটা পাশ্চাত্যের পরোক্ষ যুদ্ধ বাproxy war রাশিয়ার বিরুদ্ধে। মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী লয়েড অস্টিন এপ্রিল মাসেই ব্রাসেলসে প্রতিরক্ষামন্ত্রীদের বৈঠকে বলেছেন, ইউক্রেন এই যুদ্ধে জিততে সমর্থ, এবং রাশিয়াকে এই যুদ্ধে জয়ী হতে দেওয়া যায় না কোনোমতেই।

সম্প্রতি ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী লিজ ট্রাসও এ কথা বলেছেন, যতক্ষণ দরকার ততক্ষণ পর্যন্ত আমরা ইউক্রেনের পাশে আছি এবং আমরা শেষ পর্যন্ত থাকব- ‘as long as it takes’- সব সম্পদ, সমর্থন ও সহযোগিতা নিয়ে। একই কথার প্রতিধ্বনি ব্রাসেলস, বার্লিন, প্যারিস ও ওয়াশিংটনে। মোট কথা, ইউক্রেনের বিজয় না দেখা পর্যন্ত সামষ্টিক পাশ্চাত্য বা কালেক্টিভ ওয়েস্ট বর্তমানের পরোক্ষ যুদ্ধনীতি থেকে সরে আসবে না। এবং এই যুদ্ধ বহুকাল ধরে চলবে।
ইউক্রেন যুদ্ধের কার্যকারণ ও সম্ভাব্য পরিণতি নিয়ে তিনটি ন্যারেটিভ রয়েছে। কোন ন্যারেটিভটি ‘সত্যের কাছাকাছি’, সেটি নির্ভর করে আপনি কোন দৃষ্টিভঙ্গিকে আপনার মনে প্রাধান্য দিচ্ছেন। এটি যুক্তির কথা, কাটাকাটির লড়াই নয়। এটি ‘উত্তর আধুনিক’ একবিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে বড় যুদ্ধের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক- যাকে বলা হচ্ছে ‘ন্যারেটিভ ওয়ার’। আব্দুল মান্নান সৈয়দ লিখেছিলেন সেই কবে- ‘সত্যের মতো বদমাশ’।

এখন তিনি বেঁচে থাকলে লিখতেন- ‘ন্যারেটিভের মতো প্রতারক’। কার ন্যারেটিভ বা বয়ান কতটা আপনার মনের মধ্যে বেশি করে নাড়া দিচ্ছে- এটাই গুরুত্বপূর্ণ কথা। এখানে সত্য-মিথ্যের কোনো বালাই নেই। কেননা, সব পক্ষের বয়ানেই কিছু সত্য, কিছু মিথ্যে জড়াজড়ি করে আছে। কার সাধ্য সেসব বিচার-বিশ্নেষণপূর্বক আলাদা করে তুলে রাখে সত্যের হিরণ্ময় পাত্রে। একবিংশ শতাব্দীর আদর্শহীন পরিস্থিতির এটি একটি প্রকৃষ্ট দৃষ্টান্ত। সত্য-মিথ্যের তথ্য-বিচারের তোয়াক্কা করার দরকার নেই এখন, যতক্ষণ পর্যন্ত আপনি গ্রহণযোগ্য এবং অসংলগ্ন-নয়, এমন একটি বয়ান উপস্থাপন করতে পারছেন। এতে করে দিনকে রাত করলেও ক্ষতি নেই। কেননা, সামরিক বিশেষজ্ঞরা বলছেন যে যুদ্ধ এখন শুধু যুদ্ধক্ষেত্রেই হয় না, যুদ্ধ চলে অন্তরীক্ষ থেকে মনের অন্দরমহলে। এখন যুদ্ধ আমরা হতে ‘দেখি’; যুদ্ধের ধারাবিবরণী প্রাত্যহিক ‘শুনতে পাই’; যুদ্ধ দূরে কোথাও ঘটছে, কিন্তু আমরা রোমক কলেসিয়ামের মধ্যে বসা দর্শকের মতো টিভি বা সোশ্যাল মিডিয়ার নিয়মিত দর্শক-শ্রোতা। যুদ্ধের সর্বশেষ আপডেট না শুনে আমরা ঘুমাতে যেতে পারি না। যুদ্ধের নিত্যনৈমিত্তিক ধারাবিবরণী আজকের যুগের সবচেয়ে বড় এন্টারটেইনমেন্ট ইন্ডাস্ট্রি। ন্যারেটিভ-ওয়ার আমাদের ‘উত্তর-আধুনিক’ বিনোদনের একটি বড় উৎস। এতে জড়িত সবাই : বিবিসি, সিএনএন, আলজাজিরা, ডয়চে ভেলে, আর WION থেকে শুরু করে নিউ ইয়র্ক টাইমস, ওয়াশিংটন পোস্ট সবাই (আমাদের দেশের পত্রপত্রিকা বরাবর মূলত পাশ্চাত্যনির্ভর সংবাদ-বিশ্নেষণ পরিবেশন করে থাকে)। দৃষ্টিভঙ্গি বা অবস্থানের ওপরে নির্ভর করে কে কোন ন্যারেটিভের প্রতিনিধিত্ব করছে এই ইউক্রেন যুদ্ধ ঘিরে। এই ন্যারেটিভ-ওয়ারে তিনটি প্রধান বয়ানের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়। যুদ্ধের প্রধান তিনটি পক্ষ এই বয়ান দিয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে ন্যাটো জোটবদ্ধ দেশসমূহের বয়ান; রাশিয়ার বয়ান; এবং ইউক্রেনের বয়ান। এই তিনটি বয়ানের মূল যুক্তিগুলো নিম্নরূপ।

ন্যাটোর যুক্তি হচ্ছে, এই লড়াই গণতন্ত্রের সাথে স্বৈরতন্ত্রের। রাশিয়াকে জিততে দিলে অথরিটারিয়ানিজমের জয় হবে। রাশিয়াকে জিততে দিলে এখানেই থেমে থাকবে না এই আগ্রাসন। আরও বহু দেশ, বিশেষত পূর্ব ইউরোপের বুলগেরিয়া, রুমানিয়া, মোলদভা, পোল্যান্ড, প্রি-বাল্টিক রাষ্ট্রসমূহ- যাদের কারও কারও সাথে রাশিয়ার অভিন্ন সীমান্তও রয়েছে, তারা আক্রান্ত হবে। ন্যান্সি পেলোসি কিয়েভ সফরে এসে এককথায় অবস্থানটা পরিস্কার করেছেন এভাবে- ‘মস্তানের মস্তানি দেখে ভয় পেলে চলবে না। আমরা কিয়েভের পাশে আছি।’ জেলেনস্কিকে শান্তি-বৈঠকে যেতে নিরস্ত করেন তিনি। এটা করেছেন বরিস জনসনও একাধিকবার কিয়েভে এসে। এবং সর্বশেষে এটা করেছেন এন্থনি ব্লিঙ্কেন। সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘনের চেয়ে হঠাৎ করে কেন ডেমোক্র্যাসি বনাম অটোক্র্যাসির মধ্যকার সংঘাত বড় হয়ে উঠল, বা সংঘাতের ওরকম অ্যাবস্ট্রাক্ট বয়ানে ইউক্রেন যুদ্ধকে সংজ্ঞায়িত করা হলো তা কৌতূহলোদ্দীপক।

কেননা, খোদ ন্যাটোভুক্ত জোটের মধ্যেই অটোক্রেটিক প্রবণতার বা নিদেনপক্ষে ‘গণতন্ত্রের পথে পিছু হটার’ (ডেমোক্রেটিক ব্যাকস্লাইডিং-র) বেশ কিছু উদাহরণ পাওয়া সম্ভব। হাঙ্গেরি এবং পোল্যান্ডে অটোক্রেটিক প্রবণতা বেড়েছে বা লিবারেল ডেমোক্র্যাসির পতন ঘটেছে ইউক্রেন যুদ্ধের আগে থেকেই। এখন মারিও দ্রাঘি-পরবর্তী ইতালিও চলছে সে পথেই। তুরস্কে লিবারেল ডেমোক্র্যাসি নেই অনেক দিন ধরেই। অনেক দেশেই লিবারেল ডেমোক্র্যাসির সূচক পিছু হটছে। সম্প্রতি সুইডেনেও কট্টর ডানপন্থিরা ক্ষমতায় চলে এসেছে। এ নিয়ে আমি অন্যত্র বিস্তৃতভাবে লিখেছি ‘সমাজ, অর্থনীতি ও রাষ্ট্র’ পত্রিকার দ্বাদশ সংখ্যায় ‘প্রায়-সর্বত্র গণতন্ত্র কেন পিছু হটছে : সাম্প্রতিকের তর্ক ও বাংলাদেশ’ প্রবন্ধটিতে। মোদ্দা কথা, গণতন্ত্রের এই পিছু হটা বা অটোক্রেটিক প্রবণতার মাথা চাড়া দিয়ে ওঠা পাশ্চাত্যের সাথে বন্ধুত্বের প্রধান নির্ণায়ক আগে কখনোই ছিল না, এখনও তা নয়। রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী ল্যাভরভ সাম্প্রতিককালে পাশ্চাত্যের সেই নীতিটি জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে আরেকবার স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। অটোক্র্যাটরাও লিবারেল পাশ্চাত্যের সাম্রাজ্য বিস্তারের ক্ষেত্রে অংশীদার হতে পারে। কেননা, সে অটোক্র্যাট হতে পারে, কিন্তু সে তো আমাদের অটোক্র্যাট : ‘He may be son of a bitch, but he is our son of a bitch’। যদিও ল্যাভরভের কথাটা জেলেনস্কিকে উদ্দেশ করে বলা, কিন্তু এর অনুশীলন চলছে বিশ্বজুড়েই। নইলে পুতিনের সাথে সাক্ষাৎকারে ভারতের মোদি ‘এটি যুদ্ধের যুগ নয়’ বাক্যটি বলার জন্য এত সমাদৃত হতে পারতেন না পাশ্চাত্যের চোখে। মোদি প্রচ্ছন্নে পুতিনের মৃদু সমালোচনা করেছেন, এটিই বড় কথা; তিনি নিজে যে দেশের ভেতরে অত্যন্ত অনুদার (illiberal) নীতি অনুসরণ করে চলেছেন, সে বিষয়ে সবাই এখন নিশ্চুপ। অর্থাৎ যখন যাকে স্বার্থের কারণে কাজে লাগে, তাকেই কাছে টেনে নেব। আর স্বার্থের বিরুদ্ধে গেলেই অভিহিত করব গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের জন্য হুমকি বলে। এটাই লিবারেল ইম্পিরিয়ালিজমের নীতি। অবশ্য স্বার্থের প্রয়োজনে প্রাচ্যের দেশগুলো; যথা- রাশিয়া, চীন, ভারত- এরাও কম যায় না।

পাশ্চাত্যের বয়ানের বিপরীতে রাশিয়ার ন্যারেটিভের প্রধান যুক্তি হচ্ছে, আমরা আসলে আগ্রাসক নই, আমরাই ভিকটিম। ২৪ ফেব্রুয়ারি আমাদের সেনাবাহিনী কিয়েভ অভিমুখে যাত্রা করেছিল বটে, কিন্তু এর পেছনে রয়েছে পাশ্চাত্যের ষড়যন্ত্রের দীর্ঘ ইতিহাস। আগ্রাসকের যুক্তিগুলো পরপর সাজালে এমন দাঁড়ায়। প্রথমত, এই সংকট সৃষ্টি করেছে আসলে পাশ্চাত্য, বিশেষত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন ন্যাটো সামরিক শিবির। ১৯৯০-এর দশকে বার্লিন দেয়ালের ‘শান্তিপূর্ণ’ পতনের পর ন্যাটো কথা দিয়েছিল যে প্রাক্তন ওয়ারশ জোটভুক্ত দেশগুলো (রুমানিয়া, চেক প্রজাতন্ত্র, স্লোভাকিয়া, হাঙ্গেরি, বুলগেরিয়া, পোল্যান্ড প্রভৃতি) কখনোই ন্যাটো বলয়ের অন্তর্ভুক্ত হবে না- তারা ন্যাটোতেও থাকবে না, রাশিয়ার প্রভাব-বলয়েও থাকবে না। তারা থাকবে ‘নিরপেক্ষ’ দেশ হয়ে অস্ট্রিয়া বা সুইজারল্যান্ডের মতো। ১৯৯০ সালে গর্বাচেভ স্বয়ং মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জেমস বেকারের (১৯৮৯-৯২) কাছে বিষয়টি তুলেছিলেন এবং বেকার মৌখিকভাবে এতে সম্মতি প্রকাশ করেন। পরে মার্কিন ক্যাবিনেটে বিষয়টি তুললে বেকারকে এককথায় থামিয়ে দেন সিনিয়র বুশ। এরপর ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে গেলে পাশ্চাত্য একধরনের ট্রায়াম্ম্ফালিজমে বা জয়োচ্ছ্বাসে ভুগতে থাকে। ‘এক দশকের মধ্যেই যা করার আমাদের করে নিতে হবে, রাশিয়াকে দুর্বল করে ফেলতে হবে, সেইসাথে এর সহযোগী রাষ্ট্রগুলোকে রাশিয়া থেকে আলাদা করে ফেলতে হবে, যাতে করে পুনরায় আর সোভিয়েতের মতো শক্তিধর রাজ্যের জন্ম না হয়।’ যে পাশ্চাত্য প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল যে বার্লিনের দেয়ালের পতনের পর ‘এক ইঞ্চিও সরবে না ন্যাটো পূর্বদিকে,’ সেই ন্যাটো তার প্রতিশ্রুতি (যদিও ‘মৌখিক প্রতিশ্রুতি’) থেকে পরবর্তী সময়ে সরে আসে। এর পরের ২০ বছরে একের পর এক পূর্ব ইউরোপীয় রাষ্ট্র চলে আসে ন্যাটোর প্রভাববলয়ে এর সরাসরি সদস্যরাষ্ট্র হিসেবে। রাশিয়ার ক্ষোভের এটি প্রধান কারণ।

রাশিয়ার দ্বিতীয় যুক্তিটি ইউক্রেনকে ঘিরে। জেমস বেকারের প্রতিশ্রুতি ভেঙে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন ন্যাটোর অব্যাহত বিস্তৃতি ঘটতে থাকে পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোয়। এদিকে ইয়েলৎসিনের রাশিয়া নব্বই দশকের গোড়া থেকেই এক প্রবল অর্থনৈতিক সংকটের মুখে পড়ে। জীবনযাত্রার মানে নামে প্রবল ধস। পূর্ব ইউরোপের দিকে তাকানোর সময় ছিল না তখন রাশিয়ার। এরই সুযোগ নেয় ন্যাটোভুক্ত পাশ্চাত্য। ১৯৯৯ সালে প্রথমে যোগ দেয় চেক প্রজাতন্ত্র, হাঙ্গেরি এবং পোল্যান্ড; ২০০৪ সালে যোগ দেয় আরও সাতটি দেশ যথাক্রমে বুলগেরিয়া, এস্তোনিয়া, লাটভিয়া, লিথুয়ানিয়া, রুমানিয়া, স্লোভাকিয়া ও স্লোভেনিয়া। এসব দেশের অন্তর্ভুক্তিতে মৃদু প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে রাশিয়া (ততদিনে পুতিন রাষ্ট্রক্ষমতায়), কিন্তু তেমন বিচলিত বোধ করেনি। কিন্তু জর্জিয়া ও ইউক্রেন যখন ন্যাটোর বলয়ে চলে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেয়, তখনই তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে রাশিয়া। ২০০৮ সালের এপ্রিল মাসে বুখারেস্টে ন্যাটোর সম্মেলনে জর্জিয়া ও ইউক্রেনকে ন্যাটোর সদস্য করে নেওয়ার অঙ্গীকার করা হয়। আজকের সমস্যার সূত্রপাত এক অর্থে সেখানেই। এঙ্গেলা মেরকেল ও নিকোলাই সারকোজি এই অন্তর্ভুক্তির বিপক্ষে ছিলেন। পুতিন ন্যাটোর এই ঘোষণায় বিচলিত হয়ে ওঠেন। ২০০৮ সালে মিউনিখে প্রদত্ত একটি ভাষণে পুতিন স্পষ্ট করে এ ক্ষেত্রে রাশিয়ার অবস্থান ব্যক্ত করেন। ‘প্রথম প্রতিশ্রুতি’ ভেঙে ন্যাটো ক্রমেই পূর্বদিকে যাত্রা শুরু করেছে, কিন্তু সেটা ছিল রাশিয়ার সীমান্ত থেকে অনেক দূরের ঘটনা। ন্যাটো যদি এখন তার সৈন্যসামন্ত নিয়ে ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ে তবে তা রাশিয়া সহ্য করবে না। ইউক্রেনের সাথে হাজার মাইলের বেশি সীমান্ত রয়েছে রাশিয়ার, আর জর্জিয়ার সাথেও সীমান্ত রয়েছে তার। এতে করে রাশিয়ার নিরাপত্তা-স্বার্থ বিঘ্নিত হবে। ইউক্রেনের ভূমি থেকে ন্যাটোর মিসাইল ছুড়লে তা পাঁচ মিনিটের মধ্যে মস্কোকে আঘাত করবে। অথচ লন্ডনের প্রতি একই রকেট মস্কো ছুড়লে পৌঁছাতে লাগবে বিশ মিনিট। পাঁচ মিনিট দূরত্বে থাকা ন্যাটোর সামরিক হুমকির লাগসই উত্তর দেওয়ার জন্য যথেষ্ট সময় পাবে না রাশিয়া। সেক্ষেত্রে সারাক্ষণ তাকে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে হবে। এটা অনেকটা কিউবায় বা মেক্সিকোয় রুশ পারমাণবিক (বা অপারমাণবিক) মিসাইল সিস্টেম বসালে আমেরিকার যে উদ্বেগ হবে তার সঙ্গে তুলনা করার শামিল। সুতরাং জর্জিয়া, ইউক্রেন বা সীমান্তবর্তী অন্য কোনো প্রাক্তন সোভিয়েত রিপাবলিকে ন্যাটোর সম্প্রসারণের অশুভ চিন্তাভাবনা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে হবে। পাশ্চাত্য পুতিনের এ কথা শুনে আপাতত জর্জিয়াকে ন্যাটোর মধ্যে ঢোকানোর চিন্তা থেকে সরে আসে, এবং ইউক্রেন প্রশ্নেও একই দৃষ্টিভঙ্গি নেয়।

সমস্যা বাধল ২০১৪ সালে রাশিয়া কর্তৃক ক্রিমিয়া দখলের পর। কৃষ্ণসাগরের তীরের অনুপম রিসোর্ট-শহর ক্রিমিয়া। এই অঞ্চলের শতকরা ৯৯ ভাগ ছিলেন রুশ ভাষাভাষী এবং ক্রিমিয়া দখলের আগে থেকেই অঞ্চলটি একধরনের ‘অটোনমি’ ভোগ করে আসছিল। ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত ক্রিমিয়া রাশিয়ারই অংশ ছিল (ঐতিহাসিকভাবে)। নিকিতা ক্রুশ্চেভ এটি ইউক্রেনকে উপহার হিসেবে দেন দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে অবদানের জন্য। আগে থেকেই তারা সক্রিয় ছিল, কিন্তু ক্রিমিয়া হাতছাড়া হওয়ার পর ইউক্রেনে চরম জাতীয়তাবাদী শক্তিসমূহ রাজনৈতিকভাবে আরও শক্তি জমায়েত করতে থাকে। ফেব্রুয়ারি ২০১৪ সালে সংঘটিত হয় তথাকথিত ‘ময়দান বিপ্লব’; যার মাধ্যমে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত ভিক্টর ইয়ানুকোভিচ সরকারকে উৎখাত করা হয়। ইয়ানুকোভিচ পালিয়ে রাশিয়ায় চলে যান। রাশিয়ার সমর্থক হলেও তিনি পপুলার ভোটেই নির্বাচিত হয়েছিলেন। তড়িঘড়ি করে ইউরোপীয় ইউনিয়নে ইউক্রেনের যোগদানের বিরোধী ছিলেন তিনি। এখন যথেষ্ট তথ্য-প্রমাণ মিলেছে যে ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ‘ময়দান বিপ্লব’ সংঘটন করার পেছনে যুক্তরাষ্ট্র, ন্যাটোর কিছু দেশ, ইউক্রেনের ভেতরের তথাকথিত আজভ-ব্যাটালিয়ন ও নব্য-নাৎসি গ্রুপের সক্রিয় প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ অংশগ্রহণ ছিল। পুরো ঘটনাই ঘটানো হয়েছে ঠান্ডা মাথায় সুপরিকল্পিতভাবে- ঠান্ডা যুদ্ধের সময়ের সিআইএর প্লে-বুক অনুসরণ করে। এভাবেই দক্ষিণ আমেরিকায় বা সেন্ট্রাল আমেরিকার বিভিন্ন দেশে রাজনৈতিক পরিবর্তন আনা হয়েছে পঞ্চাশ-ষাট-সত্তরের দশকে (যারা উৎসাহী তারা নোয়াম চোমস্কির মেয়ে আভিভা চোমস্কির ২০২১ সালের বই ‘সেন্ট্রাল আমেরিকা’স ফরগটেন হিস্টোরি’ দেখতে পারেন)। রাশিয়ার জন্য ইয়ানুকোভিচের নির্বাচিত সরকারের পতন ছিল একটি বড় পরাজয় এবং তারই ফলশ্রুতি মার্চ ২০১৪ সালে রাশিয়ার ক্রিমিয়ার দখল।

ইয়ানুকোভিচের পরবর্তী সরকারসমূহের কোনো খ্যাতি ছিল না- কী সরকার পরিচালনার ক্ষেত্রে, কী সুশাসনের ক্ষেত্রে, কী পরমতসহিষুষ্ণ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কায়েমের ক্ষেত্রে। পরোশেংকো বা জেলেনস্কি কেউই সরকার পরিচালনায় সাফল্য দেখাতে পারেননি। বিশ্বব্যাংকের সুশাসনের সূচকে ইউক্রেনের স্থান ছিল অত্যন্ত নিচুতে। গণতন্ত্রের সূচকেও অবনতি হতে থাকে। উদাহরণত ২০১০ সালে লিবারেল ডেমোক্র্যাসির সূচকে ইউক্রেনের অর্জন ছিল ০.২৮; ২০১৮ সালে তা নেমে দাঁড়ায় ০.২৪। ইলেক্টরাল ডেমোক্র্যাসির সূচক ২০১০ সালে ছিল ০.৪৯; ২০১৮ সালে তা নেমে দাঁড়ায় ০.৪১। পাশ্চাত্য বা যুক্তরাষ্ট্র সুশাসন বা গণতন্ত্রের এসব অধঃগমন নিয়ে তখন মাথা ঘামায়নি। তারা তখন ব্যস্ত ছিল এই সুযোগে ইউক্রেনকে কী করে দ্রুত রাশিয়ার কাছ থেকে আরও দূরে সরিয়ে নেওয়া যায়। এই লক্ষ্যে ইউক্রেনের সংবিধানে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনা হয় দুর্নীতিবাজ পরোশেংকো সরকারের সময়ে (২০১৮ সালের ২০ সেপ্টেম্বর)। সেটি এখনও অপরিবর্তিত রয়েছে। এই সংবিধানের ১০২ ধারায় স্পষ্ট বলা আছে :

ÔThe President of Ukraine is a guarantor of the implementation of the strategic course of the state for gaining full-fledged membership of Ukraine in the European Union and the North Atlantic Treaty Organization.’

অর্থাৎ রাশিয়া যা-ই বলুক না কেন, ইউক্রেনের বর্তমান শাসককগোষ্ঠী ন্যাটোতে যোগ দিতে বদ্ধপরিকর। সাংবিধানিকভাবেই এই যোগদানকে তারা অন্যতম মূল লক্ষ্য হিসেবে স্থির করেছে। তা তারা করতেই পারে, কিন্তু এর ফাঁদে যাতে পাশ্চাত্য না পা দেয় এ নিয়ে শিকাগোর বিখ্যাত অধ্যাপক জন মিয়ারশেইমার (Mearcheimer)- এমনকি কট্টরপন্থি হেনরি কিসিঞ্জারও- বারবার সাবধানবাণী উচ্চারণ করেছেন ২০১৪ সালের পর থেকেই।
তা সত্ত্বেও পাশ্চাত্যের প্ররোচনায় ঘটনাপ্রবাহ এদিকেই গড়িয়েছে। জেলেনস্কি, যিনি কৌতুক-অভিনেতা হিসেবে রাশিয়া ও ইউক্রেন উভয় দেশেই জনপ্রিয় ছিলেন, তিনি প্রেসিডেন্ট হওয়ার পরেও এই প্রবণতা অব্যাহত থেকেছে। পরোশেংকোকে তিনি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে হারিয়েছেন দুর্নীতিবিরোধী মঞ্চ থেকে। হারিয়েছেন তিনি বিপুল ভোটে (৭০ শতাংশ ভোট পেয়ে)- কিন্তু নির্বাচনী যুদ্ধ হয়েছে দুর্নীতির প্রশ্ন ঘিরে, রাশিয়াকে সমর্থন বা প্রতিরোধ করা নিয়ে নয়। এখন তিনি ক্ষমতায় এসে বুঝতে পারছেন দুর্নীতি দমন করা কতটা কঠিন- তার নিজের নামও ‘পানামা পেপারে’ এসেছে (এ নিয়ে ২০২১ সালের ৪ অক্টোবর আলজাজিরার অনুসন্ধানী রিপোর্ট দেখুন)। কিন্তু তিনি পরোশেংকোর মতো দুর্নীতিবাজ নন এবং তুলনামূলকভাবে সদিচ্ছাপরায়ণ মানুষ। এহেন অভিনেতা-রাজনীতিককেই এখন যুদ্ধকালীন সময়ে নেতৃত্ব দিতে হচ্ছে। তার পক্ষে সম্ভবপর নয় সময়ের কাঁটা পেছনে ফেরানো : সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা হিসেবে ইউক্রেনকে তাকে ন্যাটোর দিকে নিয়ে যেতেই হবে। বাইডেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর ইউক্রেনকে ন্যাটোর মধ্যে নিয়ে আসার প্রক্রিয়া আবার জোরেশোরে শুরু করা হয়। ২০২১ সালের ১৭ নভেম্বর ইউক্রেন ও যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর মধ্যে স্ট্র্যাটেজিক পার্টনারশিপ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয। রাশিয়াকে জেলেনস্কির অবস্থান তাই বিন্দুমাত্র আশ্বস্ত করতে পারেনি।

ফেব্রুয়ারি অভিযানের শুরুতে তাই পুতিন তিনটি শর্ত রাখেন। এক, ক্ষমতার বলয় থেকে আজভ ব্যাটালিয়নের মতো নাৎসি-চক্রকে সরিয়ে নিতে হবে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে জার্মানদের সাথে সহযোগিতাকারী রাজাকার বাহিনীর নেতা ছিলেন ইউক্রেনের স্তেপান ব্যান্ডেরা ও তার দলবল। যুদ্ধের পর ব্যান্ডেরা মিউনিখে পালিয়ে যান। সেই ব্যান্ডেরাকে ইউক্রেনের ‘জাতীয় বীর’-এর সম্মান দেওয়া নিয়ে জেলেনস্কির নিজেরও আপত্তি ছিল। তারপরও আজভদের চাপে পড়ে এটা তাকে মেনে নিতে হয়েছিল। দুই, কোনোমতেই ন্যাটোতে যোগদান করা চলবে না; ইউক্রেনকে সুইজারল্যান্ড বা অস্ট্রিয়ার মতো ‘জোটনিরপেক্ষতা’ নীতি গ্রহণ করতে হবে। ‘নিউট্রাল স্টেট’ হিসেবে থাকতে হবে। তিন, ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলে দনবাস এলাকায় বসবাসরত সিংহভাগ (শতকরা ৬০ ভাগ) রুশ ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীকে নিরাপত্তা দিতে হবে। লুহানস্ক ও দানিয়েৎস্ক প্রজাতন্ত্রকে হয় ‘অটোনমি’ দিতে হবে ইউক্রেনের ভেতরে অথবা স্বাধীন এলাকা হিসেবে ঘোষণা করতে হবে। এই শেষের ‘স্বাধীনতার’ শর্তটি আলোচনা-সাপেক্ষ শর্ত ছিল। বলা বাহুল্য, পাশ্চাত্য বা ইউক্রেন এই তিন শর্তের একটিতেও সম্মতি জানায়নি। এর পরের ঘটনা সবারই জানা।
রাশিয়ার এই ন্যারেটিভের বিপরীতে ইউক্রেনের ন্যারেটিভের মূল যুক্তি হলো- আমার এলাকায় আমি যা ইচ্ছে তাই করব, তুমি রাশিয়া এসে তাতে নাক গলানোর কে? জাতিসংঘের নিয়ম অনুযায়ী এক দেশ ইচ্ছে করলেই অন্য দেশকে নিরাপত্তার অজুহাতে আক্রমণ করতে পারে না। মানচিত্র পরিবর্তন করতে পারে না। এর আগে বৃহৎ শক্তিধর যুক্তরাষ্ট্র বা ন্যাটোভুক্ত কোনো দেশ অন্য দেশকে এ রকম আক্রমণ করেনি, তা নয়।

আফগানিস্তানে, ইরাকে, লিবিয়ায়, সিরিয়ায় এ রকম আগ্রাসন নিকট অতীতে আমরা ঘটতে দেখেছি। এই সেদিনও দেখলাম যে মার্কিন বাহিনী ও তার ভাড়াটে সৈন্যদল সিরিয়ার অধিকৃত এলাকা থেকে প্রতিদিন ৬৬ হাজার ব্যারেল তেল চুরি করে পাচার করছে সেদেশের বাইরে। এই পরিমাণ সিরিয়ার মোট তেল উৎপাদনের প্রায় ৮০ শতাংশ (সিরিয়ার তেল ও জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুসারে)। কিন্তু তারপরও ইউক্রেনের সার্বভৌমত্বের যুক্তিকে অস্বীকার করা যায় না। আজ যে ইউক্রেন একটি মৃত্যুপুরীতে পরিণত হতে চলেছে তার জন্য রাশিয়া ও ইউক্রেনের মদতদাতা ন্যাটো উভয়েই দায়ী। এই যুদ্ধের মাঝখানে পড়ে প্রাণ হারাচ্ছে ইউক্রেনের নিরীহ জনগণ। উদাহরণত, তারা সবদিক দিয়েই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ইউক্রেনে চলছে আনুষ্ঠানিক মার্শাল ল। এই সামরিক আইনে যে কোনো বিরুদ্ধমতের জন্য রয়েছে কঠোর এবং অবস্থা-বিচারে চরম শাস্তির ব্যবস্থা। ১৮ বছরের ওপরের যে কোনো পুরুষকেই বাধ্যতামূলকভাবে মিলিটারি বা প্যারামিলিটারি বাহিনীর সদস্য করা হয়েছে। এ কারণেই বহির্বিশ্বের ইউক্রেনীয় উদ্বাস্তুদের মধ্যে ৯০ শতাংশই নারী ও শিশু। জেলেনস্কির শাসনের ভালো-মন্দ, ইউক্রেনীয় সামরিক কৌশলের ত্রুটিবিচ্যুতি নিয়ে কোনো কথা বলার স্বাধীনতা নেই এখন সেখানে। ইউক্রেনের বয়ানে আরও একটি যুক্তিজাল রয়েছে। ১৯৯৪ সালের বুদাপেস্ট মেমোরেন্ডামে রাশিয়া ও পাশ্চাত্যের অধিকাংশ ক্ষমতাধর রাষ্ট্রই (ফ্রান্স বাদে) স্বাক্ষর করেছিল। চুক্তি অনুযায়ী ইউক্রেনের সমস্ত পারমাণবিক অস্ত্র-সরঞ্জাম রাশিয়ার কাছে ন্যস্ত করা হয়, যদিও পারমাণবিক জ্বালানির চুল্লিগুলো চালু রাখা হয়। ইউক্রেন এই চুক্তি মেনে নেয় এই শর্তে যে তার নিরাপত্তার গ্যারান্টি দেবে যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া এবং যুক্তরাজ্য। সেখানে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল to respect the independence and sovereignty and the existing borders of Ukraine and Ôto refrain from the threat or use of force against the country। স্পষ্টতই এই প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেনি রাশিয়া। অথচ এই প্রতিশ্রুতির বিনিময়েই সেদিন ইউক্রেন রাশিয়ার হাতে ১৯০০ স্ট্র্যাটেজিক নিউক্লিয়ার ওয়ারহেড তুলে দিয়েছিল। তখন যুক্তরাষ্ট্র এই হস্তান্তরে সমর্থন জানিয়েছিল। কারণ, তার মনে দুর্ভাবনা ছিল নিউক্লিয়ার প্রলিফারেশন নিয়ে। যাতে এই অস্ত্রগুলো ভুল হাতে গিয়ে পড়ে। ২০১৯ সালে রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে স্বাক্ষরিত ২০ বছরের মৈত্রী চুক্তি নবায়িত না হয়ে শেষ হয়ে যায়। পাশ্চাত্যের চাপে পড়ে ইউক্রেন ইচ্ছে করেই ঐ চুক্তিটির নবায়ন করেনি। ফলে এখন ইউক্রেন যুদ্ধে কার্যত একা, যদিও পরোক্ষভাবে সাহায্য-সহায়তা জুগিয়ে চলেছে ন্যাটোভুক্ত দেশগুলো। অবশ্য অভিযোগ রয়েছে যে ইউক্রেনের কমান্ড-সেন্টার মূলত চালাচ্ছে ন্যাটোর সামরিক বিশেষজ্ঞরা। প্রশিক্ষণ দেওয়া ছাড়াও সরাসরি যুদ্ধক্ষেত্রেও আধুনিক অস্ত্র চালানোর মহড়া দিয়েছে ন্যাটোর অফিসাররা। ২০১৪ সালের পর থেকে প্রতি বছর ১০ হাজার করে ইউক্রেনীয় সেনা প্রশিক্ষণ দিয়েছে ন্যাটো বাহিনী। কিন্তু তা সত্ত্বেও পরোক্ষ যুদ্ধ আর প্রত্যক্ষ যুদ্ধ এক নয়। পাশ্চাত্য সরাসরি বা আনুষ্ঠানিকভাবে ইউক্রেন ফ্রন্টে অংশ নিতে পারছে না। তার কারণ, সে রকম করার অর্থ হবে রাশিয়ার সাথে প্রত্যক্ষ যুদ্ধে জড়ানো। এর অর্থ হবে- মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন যেমনটা রুশ আগ্রাসনের শুরুতে বলেছিলেন- একটি তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনা। কোনো পক্ষই সেটি চায় না। কেননা, তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধে পারমাণবিক শক্তিধর রাষ্ট্রগুলো পরস্পরের বিরুদ্ধে জড়িয়ে পড়লে তা গোটা ইউরোপকেই শ্মশানে পরিণত করবে। ওয়াশিংটন, লন্ডন, ব্রাসেলস, প্যারিস, বার্লিন, মস্কো, কিয়েভ কেউই এর আঁচ থেকে রক্ষা পাবে না।
৩. পথের শেষ কোথায়?

এত অর্থনৈতিক অবরোধ, এত বিরুদ্ধ-সমরসজ্জা, এত রাজনৈতিক বিচ্ছিন্নতা সত্ত্বেও রাশিয়া এখনও তার পূর্ব- ঘোষিত ‘স্পেশাল মিলিটারি অপারেশন’ থেকে সরে আসেনি। বরং অতিসম্প্রতি (২১ সেপ্টেম্বর) প্রেসিডেন্ট পুতিন গত সাত মাসের যুদ্ধের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভাষণটি দিয়েছেন। এতদিন যাবৎ যুদ্ধে অংশ নিয়েছে কেবল অনিয়মিত সেনাদল, যার মধ্যে রয়েছে চুক্তিভিত্তিক সৈন্য, স্বেচ্ছায় অংশগ্রহণকারী গ্রুপ ও প্যারামিলিটারি ফোর্স।

সব মিলিয়ে দুই লাখের মতো রুশ সৈন্য অংশ নিয়েছিল ফেব্রুয়ারি অভিযানে। গত সাত মাসে হতাহতের সংখ্যা কত তা নিয়ে দু’পক্ষের পরিসংখ্যানে আকাশ-পাতাল পার্থক্য। জেনারেল শোইগু বলেছেন, এ পর্যন্ত ছয় হাজারের মতো রুশ সৈন্য নিহত হয়েছে। কিয়েভ বলছে, এ পর্যন্ত ৭০ হাজার থেকে ৮০ হাজার রুশ সৈন্য প্রাণ হারিয়েছে। কিয়েভের সংখ্যা মানলে বলতে হয় যে ৭০ হাজার নিহত রুশ সৈন্যের সাথে অন্তত দুইগুণ রুশ সৈন্যের (১,৪০,০০০) আহত হওয়ার কথা। সেক্ষেত্রে নিহত-আহত মিলিয়ে রণক্ষেত্র থেকে বিদায় নিয়েছে প্রায় দুই লাখের মতো রুশ সৈন্য। তাহলে ডনবাস, খেরসন, জাপোরিঝিয়া, খারকভ ইত্যাদি ফ্রন্টে রাশিয়ার পক্ষে যুদ্ধ করছেকারা? আর কারাইবা অধিকৃত এলাকার ‘সিভিলিয়ান মিলিটারি’ প্রশাসন চালাচ্ছে দৈনন্দিন ভিত্তিতে? স্পষ্টতই হতাহতের হিসাব জেনারেল শোইগু এবং কিয়েভের সরকারি ভাষ্যের মধ্যে মাঝামাঝি কোনো সংখ্যা হবে। হয়তো ৪০ হাজার বা তার কাছাকাছি দাঁড়াবে আহত-নিহত মিলিয়ে রুশি সৈন্যবাহিনীর হতাহতের সংখ্যা। কিন্তু ৪০ হাজার সংখ্যাটি ধরে এগুলেও বলতে হয় যে এটি কোনো সামান্য ক্ষয়ক্ষতি নয়।

তার ওপরে সাম্প্রতিককালে খারকোভ অফেন্সিভে ইউক্রেন বাহিনীর সাফল্য (একলহমায় ৮০০০-১০০০০ কিলোমিটার এলাকা পুনর্দখল করা যা রুশিদের দ্বারা অধিকৃত ইউক্রেনীয় এলাকার প্রায় এক-দশমাংশ) বাড়তি চাপের সৃষ্টি করেছেরাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের ওপরে। সব মিলিয়ে পরিস্থিতি দাবি করেছে নতুন করে প্রস্তুত হওয়ার এবং পুতিন ২১ সেপ্টেম্বরের ভাষণে সেটাই করেছেন। প্রথমত,তিনি ডাক দিয়েছেন বৃহত্তর সেনা-জমায়েতের, যেটাকে রাশিয়া বলছে- ‘আংশিক মোবিলাইজেশন’। রুশ দেশে মিলিটারি রিজার্ভিস্টের সংখ্যা আড়াই কোটির মতো। রিজার্ভিস্ট মানে যারা একসময়ে সামরিক বাহিনীতে নিয়মিত সৈনিক বা অফিসার হিসেবে নিকট অতীতে অংশ নিয়েছিল- আফগানিস্তানে, চেচনিয়ায় বা সিরিয়ার যুদ্ধে অথবা এমনিতেই ডিউটিরত ছিল পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে বা রাশিয়ার বিভিন্ন সীমান্তে (আর রুশ সীমান্ত তো অনেক বড়- কৃষ্ণসাগর থেকে কামচাটকা অবধি)। এই রিজার্ভিস্টদের যুদ্ধকালীন বা কোনো জরুরি অবস্থায় পড়লে ডাক দেওয়ার বিধান রয়েছে। কিন্তু এরা বর্তমানে রুশ সৈন্যবাহিনীর ‘নিয়মিত সদস্য’ নয়। এদের মধ্যথেকে তিন লাখ অতিরিক্ত সেনাদল জোগাড় করার ঘোষণা দিয়েছেন পুতিন। স্পষ্টতই তিন লাখ হোক বা পাঁচ লাখ হোক, রিজার্ভিস্টদের আবারও নতুন করে প্রশিক্ষণ নিতে হবে যুদ্ধে যাওয়ার অত্যাবশ্যকীয় প্রস্তুতি হিসেবে। সেটা কিছুটা সময়সাপেক্ষ- অন্তত তিন থেকে ছয় মাস প্রশিক্ষণ লাগবে। পুতিন এই সাথে ইঙ্গিত দিয়েছেন- এই জমায়েত আপাতত ‘আংশিক’ বিন্যাসে হচ্ছে, কিন্তু প্রয়োজনে এটা আরওবৃহত্তর জমায়েতের দিকে যেতে পারে।

এখানে দু’তিনটি প্রশ্ন উঠতে পারে। রাশিয়া কেন তার নিয়মিত বাহিনীকে তলব করছেনা বা অন্যান্য সীমান্ত/ফ্রন্ট বা এলাকা থেকে সরিয়ে এনে ইউক্রেনের ফ্রন্টেজড়ো করছে না? এর বড় কারণ, অন্যান্য ফ্রন্ট রাশিয়া অরক্ষিত রাখতে চায় না। তা সেটা জাপানের সাথে সাখালিন সীমান্তেই হোক, চীনের সাথে সাইবেরিয়ার দীর্ঘ সীমান্তেই হোক, আর্কটিক সাগরেই হোক (যেখানে অদূরেই আছে টহলরত ন্যাটোর সেনাদল বা নৌবাহিনী), আলাস্কার অদূরেই হোক, সিরিয়ায় রাশিয়ার একমত ন্যাভাপল বেইজেই হোক বা আফ্রিকা বা অন্যান্য বিচ্ছিন্ন দেশে স্থায়ী বা অস্থায়ী ভিত্তিতে আসন-গাড়া বা যুদ্ধরত সেনাদল হোক না কেন। এদের সহসা অন্যত্র সরিয়ে ইউক্রেন ফ্রন্টে আনা যাবে না। সুতরাং আপাতত কাজ চালাতে হবে মিলিটারি রিজার্ভিস্টদের দিয়েই। তাতে ফল হবে কিনা সেটা আগাম বলা সম্ভব নয়। কিন্তু তিন লাখ বাড়তি সৈন্য মোতায়েন হলে সমগ্র দনবাস দখল ও রক্ষা করা যে রাশিয়ার পক্ষে সহজতর হবে তাতে সন্দেহ নেই।

তবে ২১ সেপ্টেম্বরের ভাষণে রাশিয়ার তুরুপের তাস ফেলা হয়েছে আংশিক মোবিলাইজেশনের মধ্য দিয়ে নয়। একটি রাজনৈতিক ঘোষণা দিয়েছেন পুতিন, যার সামরিক অভিঘাত হবে সুদূরপ্রসারী। সেটি হচ্ছে খেরসন, জাপেরিঝিয়া, লুহানস্ক ওদানিয়েস্ক রুশ অধিকৃত এলাকায় রেফারেন্ডামের জরুরি ঘোষণা। এই রেফারেন্ডামেরলক্ষ্য গণভোট নেওয়া যদি রাশিয়ায় যোগদানের পক্ষে ভোট বেশি পড়ে, তাহলে এলাকাগুলো রাশিয়ার অঞ্চল বলে স্বীকৃতি দেওয়া হবে। আর তখন ইউক্রেন যদি কোনো মিসাইল ছোড়ে দনবাস এলাকায়, তা হবে রাশিয়ার সার্বভৌমত্বে আঘাত করার শামিল। এর জন্য ন্যাটোর তরফে লংরেঞ্জ মিসাইল ছোড়ার দরকার নেই, শর্টরেঞ্জ হাইমার মিসাইলই প্ররোচনার জন্য যথেষ্ট। ফলে গণভোট-পরবর্তী পরিস্থিতিতে ন্যাটো ও রাশিয়ার মধ্যে সম্পর্কের তীব্র অবনতি হতে বাধ্য। এবং এ ক্ষেত্রে- নিজের সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য- রাশিয়া পারমাণবিক অস্ত্রাদিও ব্যবহার করতে পারে। আকাশ কালো করে দেওয়া যুদ্ধবিমানের প্রদর্শনী করতে পারে। গুঁড়িয়ে দিতে পারে ইউক্রেনের গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধ-সম্পর্কিত ডিসিশন মেকিং সেন্টার। এটা রাশিয়ারসংবিধিবদ্ধ আইনেই লিপিবদ্ধ করা আছে- কোন কোন পরিস্থিতিতে দেশটি পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করতে পারে। এবং সেটি রাশিয়া করবে বলে জানিয়েছে গণভোট-উত্তর পরিস্থিতিতে। প্রেসিডেন্ট পুতিন পাশ্চাত্যকে লক্ষ্য করে বলেছেন- ‘আমি ব্লাফদিচ্ছি না এটা অবশ্যই ঘটবে। আর যারা নিউক্লিয়ার গেইমস্‌ খেলতে চান, তাদের উদ্দেশ্যে বলি- পারমাণবিক বাতাস কোন দিকে বইবে, তা কেউ জানে না। সেটা আপনাদের দিকেও বইতে পারে।’ এর পর থেকেই ব্যাক-চ্যানেলে ক্রেমলিনের সাথে ওয়াশিংটনের আলাপ-আলোচনা শুরু হয়ে গিয়েছে এই সংবাদ মিলছে।

কিয়েভ বলছে, রাশিয়ার আগ্রাসন তার সার্বভৌমত্বের লঙ্ঘন। মস্কো বলছে, ইউক্রেনদনবাস এলাকার রুশ জনগণের আত্মনিয়মে অধিকারকে তোয়াক্কা করেনি। তাই এই যুদ্ধ। জাতিসংঘের সনদে সার্বভৌমত্ব রক্ষার অধিকার ও আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার- এই দুইয়ের মধ্যে তাত্ত্বিক ও প্রায়োগিক টেনশন রয়েছে। পাশ্চাত্য বলছে (বা প্রকারান্তরে বলতে চাইছে) যে রাশিয়াকে বৃহৎ শক্তির কাতার থেকে  ছিটকে ফেলাই তার চূড়ান্ত লক্ষ্য। অর্থনৈতিক অবরোধ দিয়ে রাশিয়াকে নতজানু করাযায়নি; উল্টো পশ্চিমা বিশ্বে ও পূর্ব ইউরোপে বাড়ছে মূল্যস্টম্ফীতি, দেশে দেশে দেখা দিচ্ছে ইকোনমিক রিভিশন হওয়ার (যখন পরপর দুই প্রান্তিকে মাথাপিছু জিডিপি সংকুচিত হতে থাকে) আশঙ্কা। সামনে আসছে শীতের বরফঢাকা মাসগুলো- বেশিরভাগ ইউরোপকেই এখন শীতকষ্টে ভুগতে হবে রাশিয়ার গ্যাস ও তেল সরবরাহ ছাড়া। রাশিয়ারও প্রভূত অথনৈতিক ক্ষতি হয়েছে সন্দেহ নেই। কিন্তু তার অবস্থা আরও খারাপ হতে পারত, অন্তত ন্যাটো যতটা ভেবেছিল ততটা খারাপ করেনি রাশিয়া। রাশিয়া কী করে অর্থনৈতিক অবরোধের প্রবল অভিঘাত এড়াল তা নিয়ে এখানে আলোচনা করছি না। শুধু বলব- এর বড় কারণ হলো, দেশটির আছে উদ্বৃত্ত খাদ্যশস্য, উদ্বৃত্ত জ্বালানি, অস্ত্রশস্ত্রের জোগান। পুতিন পুরো ডিফেন্স ইন্ডাস্ট্রিকে সামনের মাসগুলোয় ওয়ার-ফুটিং বা যুদ্ধাবস্থার সাথে সংগতিপূর্ণকাঠামোয় পরিচালনা করার নির্দেশ দিয়েছেন। রাশিয়া ক্রমেই ঠান্ডা যুদ্ধ ২.০-র জন্য প্রস্তুত হচ্ছে।

এর অর্থ- ইউক্রেনের যুদ্ধের সহসা থামার কোনো সম্ভাবনা নেই। পাশ্চাত্য রাশিয়াকে কোনোক্রমেই জিততে দেবে না। রাশিয়াও কোনোক্রমেই হারতে চাইবে না। এইভয়টাই পেয়েছিলেন অধ্যাপক মিয়েরশেইমার ও হেনরি কিসিঞ্জার পারমাণবিক কোনো বৃহৎ শক্তিকে নিবৃত্ত করা যায়, কিন্তু অবমাননা বা হিউমিলিয়েট করা যায় না। সমরখন্দের বৈঠকে চীনের শি জিনপিংও এ কথা বলেছেন- আগামী বছরগুলোয় চীন ও রাশিয়া বিশ্বে বৃহৎ শক্তিধর রাষ্ট্র (Great Power) হিসেবে নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করবে। এর অর্থ, পাশ্চাত্য যাতে রাশিয়ার বৃহৎ শক্তি-স্ট্যাটাসে হাত না দেয় এবং জোর দেয় ইউক্রেন সংকটের কূটনৈতিক শান্তিপূর্ণ সমাধানের প্রতি। নইলেএই যুদ্ধ প্রলম্বিত হবে, আর প্রলম্বিত যুদ্ধ সবসময় আরও বিপজ্জনক অবনতির দিকে অগ্রসর হয়।

আরও পড়ুন

মতামত দিন

আমাদের সম্পর্কে

We’re a media company. We promise to tell you what’s new in the parts of modern life that matter. Lorem ipsum dolor sit amet, consectetur adipiscing elit. Ut elit tellus, luctus nec ullamcorper mattis, pulvinar dapibus leo. Sed consequat, leo eget bibendum Aa, augue velit.