সারা বছর ধরে যে উৎসবের জন্য অপেক্ষায় থাকেন সনাতন ধর্মাবলম্বীরা, তার বিদায় ঘণ্টা বাজে নবমী নিশিতে। আর তাই নবমী নিশিকে ধরে রাখার আকুতিতে ভক্ত মনে বাজে একটাই সুর- ‘ওরে নবমী-নিশি, না হইও রে অবসান’। কিন্তু সময় সে তো বহমান। কোনো আকুতি-মিনতিতেই সে বদলায় না। শেষবেলার আনন্দটুকু পুরোপুরি উপভোগ করতে ব্যস্ত ছিলেন উৎসব প্রিয় বাঙালি।
তবে দেবীর বন্দনায় প্রতিটি পূজামণ্ডপে ছিল কেবলই বিষাদের ছায়া। ঢাক-ঢোল, কাঁসর-ঘণ্টাসহ বিভিন্ন বাদ্যে, আলোকিত করা ধূপ আরতি ও দেবীর পূজা-অর্চনায় কেবলই ছিল মায়ের বিদায়ের সুর। অন্যদিকে, নবমীর দিন হোমাগ্নিতে দেবীর স্তুতি। প্রথা মেনে কোনো কোনো মন্দিরে হয়েছে নবমীর বিশেষ পূজা। কোথাও হোম, কোথাও হয় ফল বলি। পূজা শুরুর সময় যেমন সংকল্প, তেমনই পূজা শেষের প্রক্রিয়া দক্ষিণান্ত। নানা উপাচারে দেবীর আরাধনা।
শাস্ত্রে আছে, নবমী তিথিতে রাবণ বধের পর শ্রী রামচন্দ্র এই পূজা করেছিলেন। নীলকণ্ঠ ফুল, যজ্ঞের মাধ্যমে অনুষ্ঠিত হয় নবমী বিহিত পূজা। নবমী পূজার মাধ্যমে মানবকুলে সম্পদ লাভ হয়। শাস্ত্র অনুযায়ী, মহানবমী বা দুর্গা নবমী হলো আসুরিক শক্তি বধে বিজয়ের দিন। শ্রী চণ্ডী থেকে জানা যায়, দুর্গা রুদ্ররূপ (মা কালী) ধারণ করে মহিষাসুর এবং তার ৩ যোদ্ধা চণ্ড, মুণ্ডা এবং রক্তবীজকে হত্যা করেন। নবমী তিথি শুরুই হয় সন্ধিপূজা দিয়ে। সন্ধিপূজা হয় অষ্টমী তিথির শেষ ২৪ মিনিট ও নবমীর সূচনার প্রথম ২৪ মিনিট জুড়ে। নবমীর বিশেষত্ব হচ্ছে হোম-যজ্ঞ।
শাপলা, শালুক ও বলিদানের মাধ্যমে গতকাল দশভুজা দেবীর পূজা অনুষ্ঠিত হয়েছে। পূজা শুরুর পর ভক্তরা প্রার্থনা করতে থাকেন দেবীর উদ্দেশে। নীল অপরাজিতা ফুল নবমী পূজার বিশেষ অনুষঙ্গ। নবমী পূজায় যজ্ঞের মাধ্যমে দেবী দুর্গার কাছে আহুতি দেয়া হয়। ১০৮টি বেলপাতা, আম কাঠ, ঘি দিয়ে এই যজ্ঞ করা হয়। পূজা শেষে যথারীতি অঞ্জলি। প্রতিটি মণ্ডপেই কয়েক দফা করে পুষ্পাঞ্জলি দেয়া হয়। এরপরই ভক্তদের মাঝে বিতরণ করা হয় প্রসাদ। নবরাত্রির নবমীতে দুর্গার ৯টি রূপ হিসেবে মেয়েদের পূজা করে খাওয়ানোর রীতিও রয়েছে। গতকাল শেষবারের মতো দেবীর আশীর্বাদ কামনায় নারী, পুরুষ, শিশু-কিশোর সব বয়সের ভক্ত নিবিষ্ট মনে প্রার্থনা করেন। কীর্তন-ভক্তিমূলক সংগীতের
মধুর সুর আর ভক্তদের কলকাকলিতে বিভিন্ন পূজা মণ্ডপে ছড়িয়ে পড়ে উৎসবের রং। পাশাপাশি পূজামণ্ডপগুলোতে ভক্ত ও দর্শনার্থীদের ছিল উপচে পড়া ভিড়। বিশেষ করে নগরীর পুরান ঢাকার সূত্রাপুর, শাঁখারী বাজার, তাঁতী বাজার এলাকায় ভিড় ছিল অনেক। গুলশান-বনানী, কলাবাগান, ঢাকেশ্বরী, রমনা কালীমন্দিরেও দলবেঁধে ঘুরে বেড়িয়েছেন নানা বয়সি মানুষ। সন্ধ্যায় মণ্ডপে মণ্ডপে অনুষ্ঠিত হয়েছে আরতী প্রতিযোগিতা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। তবে দুপুর থেকে দীর্ঘ সময় দেশের বিভিন্ন এলাকায় বিদ্যুৎ না থাকায় সেই আনন্দে ছন্দপতন হয়েছে।
আজ বুধবার বিজয়া দশমী। প্রতিমা বিসর্জনের মধ্য দিয়ে শেষ হবে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের প্রধান ধর্মীয় এই উৎসব। আজ সকাল ৮টা ৫০ মিনিটের মধ্যে দশমী পূজা সমাপন ও দর্পণ বিসর্জন করা হবে। এরপর ঢাকা শহরের বিভিন্ন পূজামণ্ডপ থেকে প্রতিমা নিয়ে ঢাকেশ্বরী মন্দির প্রাঙ্গণে এসে জড়ো হলে বিকাল ৪টায় ঢাকেশ্বরী মন্দির থেকে বের হবে শোভাযাত্রা। পরে নগরীর ওয়াইজঘাট, তুরাগ, ডেমরা, পোস্তগোলা ঘাটে বিসর্জন করা হবে প্রতিমা।
সনাতন বিশ্বাস ও বিশুদ্ধ পঞ্জিকামতে, জগতের মঙ্গল কামনায় সপরিবারে দেবী দুর্গা এবার মর্ত্যলোকে (পৃথিবী) আসেন গজে (হাতি) চড়ে। শাস্ত্রমতে, গজ হচ্ছে জ্ঞান ও সমৃদ্ধির প্রতীক এবং দেবীর উৎকৃষ্টতম বাহন। তাই দেবীর আগমন বা গমন গজে হলে মর্ত্যলোক ভরে ওঠে সুখ-শান্তি-সমৃদ্ধিতে। পূর্ণ হয় ভক্তের মনোবাঞ্ছা। পরিশ্রমের সুফল পায় মর্ত্যলোকবাসী। অতিবৃষ্টি বা অনাবৃষ্টি নয়, ঠিক যতটা প্রয়োজন ততটা বর্ষণ। দেবী সপরিবারে স্বর্গালোকে বিদায় নেবেন নৌকায় চড়ে। যার ফল হচ্ছে বন্যা হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। যাওয়ার লক্ষণ শুভ না হলেও ভক্তের বিশ্বাস, দেবী মঙ্গলময়ী। তিনি জগতের মঙ্গলই করবেন। সন্তানদের আশীষ দেবেন দু’হাত ভরে। বিজয়া দশমী উপলক্ষে বাংলাদেশ বেতার, বাংলাদেশ টেলিভিশনসহ অন্যান্য বেসরকারি টিভি চ্যানেল ও রেডিও বিশেষ অনুষ্ঠানমালা স¤প্রচার করবে। তাছাড়া জাতীয় দৈনিকগুলো এ উপলক্ষে বিশেষ নিবন্ধ প্রকাশ করবে।