মাঝনদীতে ডুবতে বসেছিল ঈশিতা কলি রায়। ১২ বছর বয়সী ছোট ভাই দর্প নারায়ণ তাকে ডুবতে দেয়নি। কাছে গিয়ে বোনের হাতটা ধরেছিল। বোনকে টানতে টানতে নিয়ে কাছের একটা চরে উঠেছিল।
চোখের পলকে নৌকাটা কাত হয়ে একেবারে উল্টেই গেল। আমি আর দর্প নৌকার ইঞ্জিনের কাছে ছিলাম। দর্পের হাতটাও ধরার সুযোগ পেলাম না। পানিতে ডুবে গেলাম। ভরা নদী। দুই দিনের টানা বৃষ্টিতে প্রচুর স্রোত। কোন দিক থেকে ভেসে কোন দিকে গেলাম, বুঝতেও পারলাম না। হাত নাড়াতে নাড়াতে পানির ওপরে মাথা তুলে দেখি, নৌকার মানুষগুলো হাবুডুবু খাচ্ছে। কারও হাত, কারও মাথা দেখতে পাচ্ছিলাম। কারও কারও কাপড় ভেসে গেল পাশ দিয়ে।
আমি অল্প সাঁতার জানি। সাঁতার কাটার চেষ্টা করে আরও ক্লান্ত হয়ে পড়ি। একটা জুতা পা থেকে খুলে গেছে, আরেকটার কারণে পা নাড়াতে পারছিলাম না। খুলব যে সে শক্তিও আমার তখন নেই। এরই মধ্যে স্রোতের তোড়ে আবার ডুবে গেলাম। মাথাটা কোনোমতে ওপরে তুললাম। আবার ডুবলাম…ডুবছি আর ভাসছি। কয়েক ঢোঁক পানিও খেয়ে ফেললাম। আশপাশে কী হচ্ছে, কিছুই বুঝতে পারছি না। শুধু পানির ওপরে মাথাটা উঠলে চিৎকার শুনতে পাচ্ছিলাম, মানুষের বাঁচার আকুতি।
আমার গলায় ওড়না ছিল। ওড়নাটাও পায়ে গিয়ে প্যাঁচ লাগল। দুই পা রীতিমতো বাঁধা পড়ে গেল। আমি আর নড়াচড়া করতে পারছি না। খুব কষ্ট হচ্ছিল তখন। মনে হচ্ছিল হয়তো ডুবেই যাব। মৃত্যুভয় পেয়ে বসল। কষ্টেসৃষ্টে মাথাটা ভাসিয়ে রাখার চেষ্টা করলাম।
এভাবে কিছুক্ষণ থাকার পর দর্পের গলা শুনতে পেলাম। তাকাতেই দেখি, সাঁতরে ও আমার কাছে চলে এসেছে। দুই হাত ছোড়াছুড়ি করছিলাম, খপ করে আমার বাঁ হাতটা দর্প ধরে ফেলল। আর বলতে থাকল, ‘কলিদি, সাঁতার দে…কলিদি, সাঁতার দে…।’
আমি ওর কথা শুনছিলাম ঠিকই, কিন্তু মুখে কিছু বলতে পারছিলাম না। সাঁতারও দিতে পারলাম না। ছোট্ট ভাইটা ধীরে ধীরে আমাকে টেনে টেনে ভাটির দিকে নিয়ে গেল। সাঁতরে যেতে যেতে দূরে থাকা উদ্ধারকারী একটা নৌকাকে ডাকছিল দর্প। কিন্তু নৌকাগুলো কাকে রেখে কাকে উদ্ধার করবে তখন। কোনো নৌকাই এল না। দক্ষিণ দিকে যেতে থাকি দুই ভাইবোন। কিছুদূর গিয়ে ছোট্ট একটা চর দেখতে পাই। দর্প আমাকে চরে টেনে তুলে বসিয়ে রাখে। কিছুক্ষণ পর উদ্ধার করা আরও কিছু লোক নিয়ে একটা নৌকা আসে আমাদের কাছে। এরপর আমি আর কিছুই বলতে পারি না।
থেমে থেমে বৃষ্টি হচ্ছিল
পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলার মাড়েয়া বালিকা উচ্চবিদ্যালয় থেকে আমি এবার এসএসসি পরীক্ষা দিচ্ছি। মহালয়ার দিন পরীক্ষা ছিল না। প্রতিবছর দিনটাতে মা-বাবার সঙ্গে বদেশ্বরী মন্দিরে দর্শন আর ভক্তি প্রণাম করতে যাই আমরা। আমার বাবা একজন দলিল লেখক। কাজ থাকায় এবার যেতে পারবেন না, আগেই জানিয়েছিলেন। বাবা যাবেন না, তাই মা–ও যাবেন না। বাবা বলেছিলেন, ‘এবার যাওয়ার দরকার নেই, আগামী বছর সবাই মিলে যাব।’
কিন্তু সকাল থেকে প্রতিবেশীদের প্রস্তুতি দেখে যেতে ইচ্ছা করছিল। আমরা দুই ভাইবোন বায়না ধরলাম, মহালয়ার অনুষ্ঠানে যাব। আমাদের আবদার ফেলতে না পেরে কাকিমার সঙ্গে যাওয়ার অনুমতি দেন বাবা।
সকাল থেকেই থেমে থেমে বৃষ্টি। সবাই প্রস্তুতি নিয়েও বাড়ি থেকে বের হতে পারছিল না। দুপুরের দিকে বৃষ্টি কিছুটা কমলে বেরিয়ে পড়ি। সবার সঙ্গে হেঁটেই ঘাটের দিকে যেতে শুরু করি। আমাদের সরদারপাড়া গ্রামের বাড়ি থেকে করতোয়ার আউলিয়ার ঘাট প্রায় দুই কিলোমিটার। তবে সোজা পথে গেলে পথ আরও কিছুটা কম। বেলা একটার দিকে আমরা ঘাটে পৌঁছাই। নদী পার হয়ে অল্প এগোলেই বদেশ্বরী মন্দির।
নৌকায় পানি ঢুকেছে
আমরা যখন নৌকায় উঠি, তখন তেমন ভিড় ছিল না। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই অনেক মানুষ চলে এল। হুড়োহুড়ি করে নৌকায় উঠে পড়ল তারা। মানুষের ভিড়ে আমরা দুই ভাইবোন নৌকার শ্যালো ইঞ্জিনের কাছে চলে এলাম। পাশেই ছিলেন মাঝি। নৌকা মাঝনদীতে পৌঁছার একটু আগে থেকেই দুলতে শুরু করল। খুব ভয় পেয়ে গেলাম। এ সময় পাড় থেকে কে যেন মাইকে মাঝিকে সাবধান হতে বলছিলেন। ঠিক তখন ইঞ্জিনটাও বন্ধ হয়ে গেল। ইঞ্জিন চালু করার চেষ্টা করলেন মাঝি। কিন্তু ইঞ্জিন আর চালু হলো না। সবার মধ্যে আতঙ্ক ভর করল। এ সময় মাঝি সবাইকে বলতে থাকলেন, ‘সবাই বসে পড়ুন, নৌকায় কিন্তু পানি ঢুকেছে।’ আমরা আগে থেকেই বসা ছিলাম। কিন্তু এত মানুষের ভিড়ে অন্যদের বসার সুযোগ ছিল না। এ রকম করতে করতেই নৌকাটা হঠাৎ এক পাশে কাত হয়ে উল্টে গেল।
হাসপাতাল থেকে বাড়ি
নদীর চর থেকে উদ্ধার করে আমাকে হাসপাতালে নেওয়া হয়েছিল। জ্ঞান ফিরলে দেখি হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে আছি। পাশে আমার বাবা বসে আছেন। কী থেকে কী হলো, বুঝে উঠতে পারছিলাম না।
সন্ধ্যায় হাসপাতাল থেকে আমাকে বাড়িতে আনা হয়। শরীর তখনো বেশ দুর্বল। মনের মধ্যে কেমন জানি একটা ভয়। আশপাশের লোকজনের কাছে শুনছিলাম, নৌকা ডুবে নাকি অনেক মানুষ মারা গেছে। এ কথা শুনে আর পড়তে বসার শক্তি পাচ্ছিলাম না। তারপরও বই নিয়ে অল্প কিছু সময়ের জন্য বসেছিলাম। কারণ, পরদিন ছিল পৌরনীতি পরীক্ষা। পরে রাতে ঘুমিয়ে পড়ি। আগে থেকেই কিছুটা প্রস্তুতি থাকার কারণে পরীক্ষাটা খুব খারাপ হয়নি।
দর্প লুকিয়ে সাঁতার কাটত
সেদিন নৌকাডুবির ঘটনায় আমাদের এলাকার অনেক মানুষ মারা গেছেন। কারও কারও ছোট্ট বাচ্চা মারা গেছে। অনেকের দুই সন্তান, দুইটাই মারা গেছে। ওই দিন হয়তো আমরাও শেষ হয়ে যেতাম। ভাগ্যিস, আমার ছোট ভাইটার সাঁতার জানা ছিল। আর ওর সাহস ছিল। এত মানুষের বাঁচার আকুতির মধ্যে সে বোনকে ফেলে নিজের জীবন নিয়ে পালায়নি। আমি ওর চেয়ে বড় হলেও অনেক কষ্ট করে সে আমাকে টেনে টেনে চরের কাছে নিয়ে গেছে। পরে শুনেছি, আমাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পর দৌড়ে বাড়িতে গিয়ে মাকে খবর দিয়েছিল দর্প।
ছোটবেলায় বাবা দর্পকে আর আমাকে সাঁতার শিখিয়েছিলেন। দর্প মাঝেমধ্যে করতোয়া নদীতে লুকিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে সাঁতার কাটতে যেত। এ জন্য ওকে অনেকবার বকেছে মা। বাড়ির পাশের পুকুরে প্রায় প্রতিদিনই সাঁতার কাটত দর্প। ডুবে ডুবে চোখ লাল করে বাড়ি ফিরত। এ জন্য মা-বাবার কাছে যে কত্তো বকা খেয়েছে, হিসাব নেই। মাঝেমধ্যে আমিও ওর সঙ্গে পুকুরে নেমেছি! দর্প যদি আগে থেকেই লুকোচুরি করে সাঁতার না কাটত, তাহলে কি আমাকে ও বাঁচাতে পারত। দর্পের মতো ভাই থাকাটা সত্যিই গর্বের।