কালো এলাচ, জিরাসহ ২৪টি মসলার জাত উদ্ভাবনের পর এবার আরেক দামি মসলা ফ্লেভার ভ্যানিলা চাষ করে আলোচনায় এসেছে বগুড়া মসলা গবেষণা কেন্দ্র। বাংলাদেশ কৃষি ইনস্টিটিউটের অধীনে দেশের একমাত্র মসলা গবেষণা কেন্দ্রটি ভ্যানিলা চাষে সফলতা পেয়েছে। এখন কৃষক পর্যায়ে ছড়িয়ে দিতে চাইছেন এ গবেষণা কেন্দ্রের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তারা। আমদানিনির্ভর ভ্যানিলা এবার দেশের কৃষি খাতে নতুন সম্ভাবনা সৃষ্টি করবে। দেশে কৃষক পর্যায়ে চাষ হলে বিদেশনির্ভরতা কমে গিয়ে ভ্যানিলা থেকেই কোটি কোটি টাকা আয় করা সম্ভব বলে মনে করছেন মসলা গবেষণার বৈজ্ঞানিকরা।
বগুড়া মসলা গবেষণা কেন্দ্র সূত্রে জানা যায়, প্রতি বছরই বিদেশ থেকে মসলা আমদানিতে গুনতে হয় কয়েক হাজার কোটি টাকা। মসলা জাতীয় ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি করে আমদানিনির্ভরতা কমাতে জেলার শিবগঞ্জ উপজেলায় ১৯৯৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় বগুড়া মসলা গবেষণা কেন্দ্র। প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরের বছর থেকে গবেষণা কার্যক্রম শুরু হয়। গবেষণা কেন্দ্রের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তারা এ পর্যন্ত ২৪টি মসলা জাতীয় ফসলের ওপর ৫০ জাত উদ্ভাবন করেছেন। এর মধ্যে রয়েছে পেঁয়াজের সাতটিসহ মরিচ, রসুন, আদা, হলুদ, ধনিয়া, কালিজিরা, মেথি, ফিরিঙ্গি, মৌরি, আলুবোখারা, দারুচিনির উন্নত জাত, যা কৃষক পর্যায়ে চাষাবাদ হচ্ছে। কালো এলাচ, গোলমরিচের বাণিজ্যিক চাষাবাদসহ চইঝাল, ফিরিঙ্গি, পোলাও পাতা, লেমনগ্রাস, আম আদা, জিরা, কাবাব চিনি, চিভস, অলস্পাইস, কারিপাতা, পান বিলাস, লবঙ্গ, পেস্তা, জায়ফল বিভিন্ন মসলার জাত গবেষণাধীন এবং পেঁয়াজ ও কাঁচা মরিচের গুড়া উদ্ভাবন হয়েছে এ কেন্দ্রে। সর্বশেষ মূল্যবান মসলা জাতীয় ফসল ভ্যানিলা চাষে সফল হয়েছেন এ কেন্দ্রের গবেষকরা। ভ্যানিলা আইসক্রিম, কেক, চকলেট, মিষ্টি, ফিরনি, পায়েস ও কাস্টার্ড জাতীয় খাবারের স্বাদ বড়িয়ে দেয় বহু গুনে। ভ্যানিলার নানা রকম সুবাস মানুষকে আকর্ষণ করে আসছে যুগ যুগ ধরে। ভ্যানিলার স্বাদের উৎস হচ্ছে এক ধরনের অর্কিড ফুলের বীজ। অর্কিডটির বোটানিক্যাল নাম ভ্যানিলা প্লানিফোলিয়া। অর্কিডটি মূলত একটি লতানো উদ্ভিদ যা অন্য একটি গাছকে আশ্রয় করে বেড়ে ওঠে। এর আদি আবাস মেক্সিকো বলে জানা যায়। কিন্তু বর্তমানে ইন্দোনেশিয়া প্রায় ৫৮ শতাংশ ভ্যানিলা উৎপাদন ও রফতানি করে। ভ্যানিলার গাছটি দেখতে গাঢ় সবুজ বর্ণের হলেও ফুলটির রঙ সাধারণত হলুদ রঙের। স্বল্পস্থায়ী এ ফুলটির পরাগায়ন হলে সেখান থেকে চ্যাপ্টা বরবটির মতো এক ধরনের ফল হয় যাতে অনেক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বীজ থাকে। এ ফল ও বীজে যে অ্যাসেনসিয়াল অয়েল থাকে তা থেকেই তৈরি হয় ভ্যানিলা ফ্লেভার। এ ফ্লেভার শুধু খাবারেই নয়, কসমেটিকস ও পারফিউমেও ব্যবহার হয়ে আসছে। এ ভ্যানিলার স্বাদ নেয়ার জন্য এখন পর্যন্ত বাইরের দেশের ওপর নির্ভর করতে হয়। এ অবস্থায় বিদেশনির্ভরতা কমিয়ে আনতে ভ্যানিলা চাষ করে বগুড়ার মসলা গবেষণা কেন্দ্রের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তারা সফলতা দেখিয়েছেন। ২০১৯ সালে ইন্দোনেশিয়া থেকে কাটিং চারা নিয়ে আসার পর তা রোপণ করে ফুল ও ফল পাওয়া যায়। ভ্যানিলা চারা গাছে তিন বছর পর ফুল আসে। ফুল আসার পর হাত দিয়ে পরাগায়ন করা হয়। এ প্রক্রিয়ায় পরাগায়ন থেকে ফলও ধরেছে।
বগুড়া মসলা গবেষণা কেন্দ্রের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা আবু হেনা ফয়সাল ফাহিম জানান, তিন বছর আগে ইন্দোনেশিয়া থেকে পরীক্ষামূলক একটি কাটিং চারা নিয়ে আসা হয়। এরপর তিন বছর এ চারা লালন-পালন করার পর চলতি বছর ফুল ও ফল ধরেছে। লতা জাতীয় এ গাছের চারা এখন ছড়িয়ে পড়েছে অনেক জায়গাজুড়ে। ভ্যানিলা গাছে ফল আসে মার্চ-এপ্রিলে, আর ফল পাকে নভেম্বর ও ডিসেম্বরে। ফল পাকার পর এর ফ্লেভার বের করা হবে। আপাতত ভ্যানিলা চাষের সফলতা আসায় এখন বাণিজ্যিক চাষের ওপর গবেষণা চলছে। দামি এ মসলা চাষে আলাদা করে কোনো জায়গা নষ্ট হবে না। চাষের জন্য উঁচু জায়গা, পাহাড়ি বনাঞ্চল, বড় বড় ফলদ বাগানের গাছের ছায়ায়, পতিত জমি ছাড়াও বাড়ির আশপাশে বড় বড় গাছের ছায়ায়ও চাষাবাদ করা যাবে। সম্ভাবনাময় এ দামি মসলার উৎপাদন নিয়ে তারা আশাবাদী। গবেষণা করে ভ্যানিলার ফ্লেবার বের করা এবং ২০২৩ সালের মার্চের পর কৃষি মন্ত্রণালয়ের ছাড়পত্রের জন্য আবেদন করবেন। এরপর মন্ত্রণালয়ের ছাড়পত্র পেলে এ মসলা চাষ পদ্ধতি কৃষক পর্যায়ে ছড়িয়ে দিতে চান। বর্তমানে ভ্যানিলা চাষের পুরো বিষয়টি আবহাওয়া উপযোগী জাত চিহ্নিত করে চলছে গবেষণা। এ গবেষণায় উদ্ভাবিত উন্নত নতুন জাত চাষাবাদে উৎপাদন ও উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি হবে। এতে আমদানিনির্ভরশীলতা কমে আসবে বলে বিশেষজ্ঞদের প্রত্যাশা।
বগুড়া মসলা গবেষণা কেন্দ্রের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. শৈলেন্দ্র নাথ মজুমদার বলেন, বগুড়ায় ভ্যানিলা চাষে সফলতা পাওয়া গিয়েছে। মসলা জোরদারকরণ প্রকল্পের মাধ্যমে উদ্ভাবিত জাতগুলো ও প্রযুক্তির ব্যাপারে কৃষককে বিভিন্নভাবে অবহিত করা হচ্ছে। প্রকল্পের ফলে বীজ উৎপাদন বেড়েছে। কৃষক প্রশিক্ষণ, মাঠ দিবসসহ বিভিন্ন কর্মশালায় আমাদের প্রযুক্তি কৃষকের মাঝে ছড়াতে সক্ষম হয়েছি। যেহেতু অন্যান্য মাঠ ফসলের তুলনায় মসলা চাষ লাভজনক। তাই কৃষকের আগ্রহও বেড়েছে। পাশাপাশি প্রতিকূল আবহাওয়া বা প্রতিকূল পরিবেশ বিশেষ করে চরাঞ্চল, লবণাক্ত এলাকাসহ পাহাড়ি এলাকায় মসলা উৎপাদনের কার্যক্রম হাতে নেয়া হয়েছে। আমাদের দেশে জিরা হতো না, গত বছর আমাদের বিজ্ঞানীরা জিরার জাত উদ্ভাবন করেছেন। মসলার নতুন নতুন জাত আসছে যা দিয়ে মসলার ঘাটতি অনেকখানি পূরণ হবে।