রাজধানীর শেওড়াপাড়া এলাকায় গত শুক্রবার বিকেলে একটি সুপারশপে যান বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মী শাকিলা আক্তার। সেখান থেকে অন্যান্য পণ্যের সঙ্গে শর্ষে ও কালিজিরা ফুলের দুই কেজি মধুও কেনেন তিনি। জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আগে সারা বছরেও দুই কেজি করে মধু কিনতাম না, গত এক বছরে পরিবারের জন্য ছয় কেজির মতো মধু কিনেছি আমি।’
করোনা মহামারি শুরুর পর তাঁর পরিবারে মধু ব্যবহারের পরিমাণ বেড়েছে বলে জানান শাকিলা। শুধু শাকিলা আক্তারই নন, করোনার সময় থেকে দেশের অনেক পরিবারেই মধু ব্যবহারের পরিমাণ বেড়েছে। একই সঙ্গে বেড়েছে মধু উৎপাদন, আমদানি ও বিক্রিও। বর্তমানে দেশে মধু ও এর উপজাত পণ্য মিলিয়ে প্রায় ৭৫০ কোটি টাকার বাজার আছে।
বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের (বিসিক) বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত অর্থবছরে দেশে মধু উৎপাদিত হয়েছে ১০ হাজার ৬৫৫ মেট্রিক টন (১ মেট্রিক টনে ১ হাজার কেজি)। এর আগের অর্থবছরে মোট মধু উৎপাদিত হয়েছিল ৪ হাজার ৬২২ মেট্রিক টন। অর্থাৎ এক বছরে মধু উৎপাদন বেড়েছে ১৩০ গুণ।
৭৫০ কোটি টাকার বাজার
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপ্রকল্প পরিচালক ফ ম মাহবুবুর রহমান বলেন, ফসলের পরাগায়ন বাড়ানোই মৌমাছি চাষের মূল উদ্দেশ্য। দেশে যেসব মধু পাওয়া যায়, তা মূলত প্রাকৃতিক, চাষ ও আমদানি—এই¬ তিনটি উৎস থেকে আসে। মোট উৎপাদিত মধুর ৯৫ শতাংশই আসে চাষের মাধ্যমে। দেশে প্রায় ৮ হাজার মৌচাষি আছেন। তাঁরা ৭০ হাজার মৌমাছির বাক্সে মধু চাষ করেন। চাষের মধু ছাড়াও বসতবাড়ির আশপাশ ও বনাঞ্চলে মৌমাছির চাক থেকে প্রাকৃতিক মধু পাওয়া যায়।
প্রাকৃতিক মধুর বড় সংগ্রহ আসে সুন্দরবন অঞ্চল থেকে। বন বিভাগ জানিয়েছে, সুন্দরবন থেকে গত অর্থবছরে প্রায় ৩০০ মেট্রিক টন মধু (৩ হাজার কুইন্টাল) ও দেড় শ মেট্রিক টন মোম আহরণ করা হয়েছে। সব মিলিয়ে প্রায় ১০ হাজার মেট্রিক টন মধু উৎপন্ন হয় দেশে। এর বাইরে বিভিন্ন দেশ থেকে বছরে প্রায় ২ হাজার মেট্রিক টন মধু আমদানি হয়।
খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, মধুর প্রকারের ওপর এর দাম নির্ভর করে। খুচরা পর্যায়ে প্রতি কেজি মধু গড়ে ৬০০ টাকা দরে বিক্রি হয়।
সে হিসাবে দেশে উৎপাদিত ১০ হাজার ৬৫৫ মেট্রিক টন মধুর দাম হয় ৬৩৯ কোটি টাকা। গত বছর দেশে প্রায় ৬০ কোটি টাকার মধু আমদানি হয়েছে। এ ছাড়া মোমসহ মৌচাক থেকে পাওয়া অন্যান্য উপজাত বিক্রি হয় প্রায় ৫০ কোটি টাকার। সব মিলিয়ে দেশে মধুর বাজার প্রায় ৭৫০ কোটি টাকার।
উৎপাদন কোথায় বেশি
সিরাজগঞ্জের মধুচাষি আবদুর রশিদ দুই দশক ধরে মধু চাষ করছেন। তিনি বলেন, সারা দেশেই কমবেশি চাষের মধু পাওয়া যায়। এর মধ্যে সিরাজগঞ্জ, পাবনা, ঢাকার ধামরাই, মানিকগঞ্জ, টাঙ্গাইল, গাজীপুর, শেরপুর ও ময়মনসিংহে বেশি উৎপাদন হয়। মধুর ধরনের মধ্যেও আছে বৈচিত্র্য—শর্ষে, কালিজিরা, লিচু, ধনিয়া, খেসারিসহ বেশ কিছু ফুলের মধু বাজারে পাওয়া যায়। তবে প্রাকৃতিক চাকে পাওয়া মিশ্র ফুলের মধুর চাহিদা সবচেয়ে বেশি। আর প্রাকৃতিক মধুর সবচেয়ে বড় জোগান আসে সুন্দরবনসহ বিভিন্ন বনাঞ্চল থেকে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিসিকের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, দেশে মধুর চাহিদা অনুসারে উৎপাদন বাড়ানো যাচ্ছে না। বর্তমানে মৌচাষি তৈরির জন্য বিসিকের মাত্র ছায়টি প্রশিক্ষণকেন্দ্র আছে। এর মাধ্যমে সারা দেশে প্রশিক্ষণ ও তদারকি কার্যক্রম ঠিকভাবে চালাতে পারছে না সংস্থাটি।
আমদানি
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুসারে, ২০২০–২১ অর্থবছরে দেশে প্রায় ১ হাজার ৭৩১ মেট্রিক টন বা ৬০ কোটি ৬৫ লাখ ৪৩ হাজার টাকার মধু আমদানি হয়েছে। এর আগের অর্থবছরে আমদানি হয়েছিল প্রায় ৫৫০ মেট্রিক টন বা ১৮ কোটি ৫৮ লাখ টাকার মধু। চীন, ভারত, সংযুক্ত আরব আমিরাত, পাকিস্তান, তুরস্ক, সৌদি আরব, থাইল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ডসহ বেশ কয়েকটি দেশ থেকে এসব মধু আসে।
বাজারে প্রচলিত বিদেশি মধুর ব্র্যান্ডগুলোর মধ্যে ভারতের ডাবর, সাফোলা, লিটল বি, পাকিস্তানের বি হাইভস, অস্ট্রেলিয়ার অজিবি, সৌদি আরবের আল শিফা, দুবাইয়ের আল শাফি, নিউজিল্যান্ডের মানুকা হানি ইত্যাদি বিভিন্ন সুপারশপ ও খুচরা বিক্রয়ের দোকানে বিক্রি হয়। এ ছাড়া স্বপ্ন মধু, ট্রপিকা, এপি মধু, পুষ্টি মধুসহ বেশ কিছু দেশি ব্র্যান্ডও আছে। ব্র্যান্ড ছাড়া স্থানীয়ভাবে প্রক্রিয়াজাত মধুও উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বিক্রি হয়।
সুপারশপ স্বপ্নের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে জানান, প্রতিষ্ঠানটি বছরে প্রায় ৬০ মেট্রিক টন মধু বিক্রি করে; এর মধ্যে ৪০ মেট্রিক টন আমদানি করা। অর্থাৎ মোট বিক্রির প্রায় ৬৫ শতাংশ আমদানি করা, বাকিটা স্থানীয় বাজার থেকে সংগ্রহ করা। গত এক বছরে মধু বিক্রি ২০ শতাংশ বেড়েছে বলে জানান তিনি।
বাজার সম্ভাবনা
শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কীটতত্ব বিভাগের অধ্যাপক ও মৌমাছি বিশেষজ্ঞ মোহাম্মদ সাখাওয়াত হোসেন বলেন, দেশে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে মধু সংগ্রহের উৎস আছে। এসব উৎসের সঠিক ব্যবস্থাপনা করা গেলে বছরে ২০ হাজার মেট্রিক টন পর্যন্ত মধু সংগ্রহ করা সম্ভব। সে হিসাবে বর্তমানে দেড় হাজার কোটি টাকার বাজার সম্ভাবনা আছে এই খাত থেকে।