বিশ্বে কয়লার সবচেয়ে বড় খনি ধরা হয় যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াইয়োমিংয়ের নর্থ অ্যান্টিলোপ রোশেল কোল মাইনকে। মাইনিং টেকনোলজির তথ্য অনুযায়ী, এখানে কয়লার উত্তোলনযোগ্য মজুদ ১৭০ কোটি টন। বাংলাদেশে ভূগর্ভস্থ কয়লার সবচেয়ে বড় মজুদটি অবস্থিত জয়পুরহাটের জামালগঞ্জে। ছয় দশক আগে এখানে জরিপ ও অনুসন্ধান চালিয়েছিল জাতিসংঘ ও তত্কালীন পাকিস্তান সরকারের খনিজ সম্পদ বিশেষজ্ঞ দল।
সেই সময়ের জরিপের ভিত্তিতে অনুমান করা হয় এখানে কয়লার মোট মজুদ রয়েছে ১০৫ কোটি ৩০ লাখ টন। এরপর ২০১৫ সালে খনিটিতে কয়লা খনির গ্যাস বা কোল বেড মিথেন অনুসন্ধানে ভারতীয় এক প্রতিষ্ঠানকে নিয়োগ দেয় পেট্রোবাংলা। মাইনিং অ্যাসোসিয়েট প্রাইভেট লিমিটেড (এমএপিএল) নামে ওই প্রতিষ্ঠানের পরের বছর প্রকাশিত জরিপ প্রতিবেদনে বলা হয়, জামালগঞ্জে কয়লার প্রকৃত মজুদ আগের হিসাবের চেয়েও কয়েক গুণ বেশি হতে পারে, যার সম্ভাব্য মোট পরিমাণ ৫৫০ কোটি টন। এর মধ্যে কতটুকু উত্তোলনযোগ্য তা এখনো নিরূপণ করা যায়নি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এর এক-দশমাংশও (৫৫ কোটি টন) যদি উত্তোলন করা যায়, তাহলেও খনিটি উত্তোলনযোগ্য কয়লার মজুদের দিক থেকে বিশ্বের শীর্ষ ১০ খনির তালিকায় উঠে আসবে। এ তালিকায় বর্তমানে নবম ও দশম স্থানে রয়েছে যথাক্রমে অস্ট্রেলিয়ার গুনিয়েলা রিভারসাইড ও সারাজি খনি। এ দুই খনিতে উত্তোলনযোগ্য কয়লার মজুদ যথাক্রমে ৫৪ কোটি ৯০ লাখ টন ও ৫০ কোটি ২ লাখ টন।
আরো গভীর অনুসন্ধানের মাধ্যমে খনিটির মজুদ যথার্থভাবে নিরূপণ ও নিশ্চিত করা গেলে জামালগঞ্জ শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বের সবচেয়ে বড় কয়লা খনিগুলোর একটি হিসেবে স্বীকৃতি পাবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের ভাষ্যমতে, বিপুল পরিমাণ মজুদ সত্ত্বেও এখনো খনিটির সম্ভাবনাগুলোকে কাজে লাগানো যায়নি। এখন পর্যন্ত জামালগঞ্জে মোট এবং উত্তোলনযোগ্য কয়লার প্রকৃত পরিমাণ নিরূপণ হয়নি। গভীরতা অনেক বেশি হওয়ায় এখান থেকে কয়লা উত্তোলনে জ্বালানি খাতের নীতিনির্ধারকদের মধ্যে তেমন কোনো আগ্রহও দেখা যায়নি।জাতিসংঘ ও পাকিস্তান সরকারের বিশেষজ্ঞদের অনুসন্ধানে জামালগঞ্জে কয়লা খনি আবিষ্কৃত হয় ১৯৬২ সালে। এরপর খনিটিতে উল্লেখযোগ্য মাত্রায় অনুসন্ধান চালানো হয় পাঁচ দশকেরও বেশি সময় পর ২০১৫ সালে। তবে সে সময় মূলত খনিতে মজুদ গ্যাস বা কোল বেড মিথেনের খোঁজেই অনুসন্ধান চালানো হয়েছিল। ১৯৬২ সালের প্রথম অনুসন্ধানে খনির আয়তন নির্ধারণ করা হয়েছিল ১১ দশমিক ৬৬ বর্গকিলোমিটার। পরের জরিপে এর সম্ভাব্য আয়তন নির্ধারণ হয় ৬৪ বর্গকিলোমিটার। এছাড়া খনিতে কয়লার স্তরের পুরুত্বও পাওয়া গেছে আগের চেয়ে অনেক বেশি।
বাংলাদেশের অন্যান্য স্থানের মতো জামালগঞ্জের খনিতে মজুদকৃত কয়লাও অনেক বেশি উচ্চমানসম্পন্ন বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের হাইড্রোকার্বন ইউনিটের তথ্য অনুযায়ী, জামালগঞ্জের কয়লার ক্যালোরিফিক ভ্যালু বা শক্তি উৎপাদনক্ষমতা নির্ধারণ হয়েছে প্রতি পাউন্ডে ১১ হাজার ব্রিটিশ থার্মাল ইউনিট (বিটিইউ/পাউন্ড)। যদিও অন্যান্য উৎসের তথ্য অনুযায়ী, তা ১২ হাজার ১০০ বিটিইউ/পাউন্ডও হতে পারে। এ ধরনের কয়লার গঠন শুরু পারমিয়ান যুগে (২৫ কোটি বছর আগে)। অত্যন্ত উচ্চমানের এ কয়লায় সালফারের পরিমাণ খুবই সামান্য।
খনিটিকে যথাযথ কাজে লাগানো গেলে তা দেশে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের চলমান ও ভবিষ্যৎ সংকট মোকাবেলায় বড় ধরনের ভূমিকা রাখবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। যদিও খনিটির গভীরতা অনেক বেশি হওয়ায় এখানকার কয়লা উত্তোলন নিয়ে নীতিনির্ধারকদের মধ্যে বরাবরই বড় ধরনের সংশয় কাজ করেছে। তাদের ভাষ্যমতে, বাংলাদেশের অন্যান্য কয়লা খনির গভীরতা যেখানে ১২০ থেকে ৫০০ মিটার, সেখানে জামালগঞ্জের কয়লা ৯০০ থেকে ১ হাজার মিটার গভীরে অবস্থিত। এত গভীর থেকে কয়লা উত্তোলন শুধু কঠিন নয়, একই সঙ্গে অত্যন্ত ব্যয়বহুলও। বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করে সেখান থেকে কয়লা তুলে আনা হলেও তা বাণিজ্যিকভাবে লাভজনক হবে কিনা, সে বিষয়ে জ্বালানি খাতের নীতিনির্ধারকদের মধ্যে এখনো সংশয় রয়ে গিয়েছে।
খনিটি থেকে বাণিজ্যিকভাবে লাভজনক উপায়েই কয়লা তুলে আনা সম্ভব বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের ভাষ্যমতে, অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে খনিটি থেকে কয়লা উত্তোলন করা যাবে। তবে এজন্য অনেক উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করতে হবে, যার জন্য বিশেষভাবে বড় বিনিয়োগের প্রয়োজন। কয়লা খনিটিতে প্রয়োজনীয় এ বিনিয়োগ নিশ্চিত করা গেলে জ্বালানি সমস্যার টেকসই একটি সমাধান হাতে আসবে। স্থানীয় চাহিদা পূরণের পাশাপাশি রফতানির সম্ভাবনা তৈরি হবে। এছাড়া খনির গভীরতা অনেক বেশি হওয়ায় একদিক থেকে কিছু সুবিধাও রয়েছে। এখান থেকে ভূগর্ভস্থ পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলনের উদ্যোগ নেয়া হলে গভীরতার কারণেই জামালগঞ্জে বড়পুকুরিয়ার মতো ভূমিধসের কোনো সম্ভাবনা নেই। ওপরের মাটিও বেশ কঠিন ও শক্ত প্রকৃতির। ফলে দুর্ঘটনার আশঙ্কাও কম।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ এবং ভূতত্ত্ববিদ বদরূল ইমাম বলেন, বড় এ কয়লা খনিটি থেকে ভূগর্ভস্থ পদ্ধতিতে উত্তোলন করা যেতে পারে। ইউরোপ ও আমেরিকার দেশগুলোয় এমনকি প্রতিবেশী ভারতেও এর চেয়ে গভীর কয়লা খনি থেকে উত্তোলন করা হচ্ছে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে এ ধরনের বৃহৎ একটি কয়লা খনি যদি দ্রুত উৎপাদনে আনা যায়, সেক্ষেত্রে পণ্যটিতে আমদানি নির্ভরতা কমে যাওয়ার পাশাপাশি বিদ্যুৎ উৎপাদনেও খরচ অনেক কমে আসবে। জ্বালানি পণ্যের বর্তমান বাজার বিবেচনায় এ ধরনের খনিগুলো নিয়ে সরকার নতুন করে চিন্তাভাবনা শুরু করতে পারে। এছাড়া পরীক্ষামূলকভাবে ইউসিজি (আন্ডারগ্রাউন্ড কোল গ্যাসিফিকেশন) পদ্ধতিও ব্যবহার করা যেতে পারে।
খনিটি থেকে উত্তোলন নিয়ে এখন পর্যন্ত তেমন কোনো উদ্যোগ না দেখা গেলেও এজন্য জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছিল পাকিস্তান আমলেই। সরেজমিনে দেখা গেছে, বর্তমানে এ জমিতে খনি রক্ষণাবেক্ষণ কাজে ব্যবহূত কোনো স্থাপনা নেই। ২০১৯ সালে পেট্রোবাংলা অধিগ্রহণকৃত জমির সীমানাপ্রাচীর নির্মাণ করে। একজন নিরাপত্তা কর্মী দীর্ঘ ২৫ বছর ধরে খনি এলাকাটি দেখভাল করছেন। বর্তমানে খনির জমিতে চাষাবাদ হচ্ছে। জমিটির দেখভালে নিয়োজিতরা জানিয়েছেন, একসময় সেখানে কয়লা অনুসন্ধানে কূপ খনন করা হয়েছিল, এখন সেটি মাটি ভরাট হয়ে গেছে। বর্তমানে অধিগ্রহণকৃত জমি সরাসরি পেট্রোবাংলা দেখভাল করছে।
আগামী কিছুদিনের মধ্যেই মেগা প্রকল্পের ভিত্তিতে বাস্তবায়নকৃত বেশ কয়েকটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদনে আসার কথা রয়েছে। এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রে জ্বালানি হিসেবে আমদানীকৃত কয়লা ব্যবহারের কথা রয়েছে। যদিও জ্বালানি পণ্যের বর্তমান বাজার পরিস্থিতি বিষয়টিকে অনেকটাই অনিশ্চিত করে তুলেছে। আবার আমদানিনির্ভর কয়লা দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনে খরচও পড়ে অনেক বেশি। অথচ বাংলাদেশে এখনো বিপুল পরিমাণ কয়লার মজুদ অব্যবহূত রয়ে গিয়েছে। মানের দিক থেকেও এসব কয়লা সর্বোত্কৃষ্ট। ফলে বিদ্যুৎ উৎপাদনে কয়লা ব্যবহারও করতে হয় কম। বিশ্ববাজারে জ্বালানি পণ্যের মূল্যে যে অস্থিতিশীলতা দেখা দিয়েছে, তাতে স্থানীয় পর্যায়ে কয়লা উত্তোলন বাড়ানোর উদ্যোগ গ্রহণ জরুরি হয়ে পড়েছে।
পরিস্থিতি বিবেচনায় পেট্রোবাংলাও এখন কয়লার স্থানীয় উত্তোলন বৃদ্ধিতে মনোযোগ দিয়েছে। এরই মধ্যে বড়পুকুরিয়া থেকে পুনরায় কয়লা উত্তোলনে কার্যক্রম শুরু হয়েছে। একই সঙ্গে দেশের অন্যান্য খনি থেকেও কয়লা উত্তোলনে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিচ্ছে সংস্থাটি। যদিও জামালগঞ্জ নিয়ে সংস্থাটির এখনো তেমন কোনো দৃশ্যমান উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান নাজমুল আহসান বণিক বার্তাকে বলেন, আমরা এখন বড়পুকুরিয়া থেকে কয়লা উত্তোলন করছি। এর পাশাপাশি দীঘিপাড়া থেকে কয়লা উত্তোলনের জন্য আমরা সম্ভাব্যতা সমীক্ষা করেছি। সেখান থেকে আমরা ভূগর্ভস্থ পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলন করতে পারব। এর বাইরে বাকিগুলো নিয়ে ওই অর্থে এখন পর্যন্ত কোনো সমীক্ষা হয়নি। সমীক্ষা হলে জামালগঞ্জসহ আরো যেসব কয়লা খনি রয়েছে, সেগুলোর বিষয়ে বলা যাবে যে সেখান থেকে কয়লা উত্তোলন করা যাবে কিনা।
কয়লার ভূগর্ভস্থ গ্যাসিফিকেশনের (আন্ডারগ্রাউন্ড কোল গ্যাসিফিকেশন বা ইউসিজি) মাধ্যমে জামালগঞ্জের খনিটির কয়লাকে কাজে লাগানো যায় বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। ইউসিজি হলো মাটির নিচ থেকে কয়লা না তুলেই সেখান থেকে শক্তি উৎপাদনে ব্যবহূত একটি পদ্ধতি। এ পদ্ধতিতে ভূগর্ভের কয়লার স্তরকে অক্সিজেন ও বাষ্প দিয়ে নিয়ন্ত্রিতভাবে পুড়িয়ে ভেতরে উত্পন্ন গ্যাসকে পাইপলাইন দিয়ে তুলে আনা হয়। এরপর তা বিদ্যুৎকেন্দ্রে সরবরাহ করা হয়। তুলনামূলক বেশি গভীরতার খনিগুলোয় মজুদকৃত কয়লা কাজে লাগাতে এ পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। চীন, রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, ইন্দোনেশিয়া, ভারত ও উজবেকিস্তানের মতো দেশগুলো এখন ইউসিজি পদ্ধতিকে কাজে লাগাচ্ছে।
জিওলজিক্যাল সার্ভে অব বাংলাদেশ (জিএসবি) এবং মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন গবেষক কয়েক বছর আগে জামালগঞ্জে ইউসিজি পদ্ধতির ব্যবহারযোগ্যতা নিয়ে গবেষণা চালিয়েছেন। তাদের সে গবেষণার ফলাফল ‘আন্ডারগ্রাউন্ড কোল গ্যাসিফিকেশন (ইউসিজি)—আ পাইলট স্টাডি ইন সার্টেন এরিয়া অব জামালগঞ্জ কোল বেসিন, জয়পুরহাট ডিস্ট্রিক্ট, বাংলাদেশ’ শিরোনামে প্রকাশ হয়েছে। ওই গবেষণা প্রতিবেদনের উপসংহারেও সুপারিশ টেনে বলা হয়েছিল, বাংলাদেশে বিদ্যুৎ সংকট সমস্যার সমাধান পেতে হলে জামালগঞ্জে ইউসিজি পদ্ধতির প্রয়োগ করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে জামালগঞ্জের যেসব স্থানে কয়লার পুরুত্ব ও মানসহ অন্যান্য আনুষঙ্গিক বিষয় সবচেয়ে বেশি অনুকূলে থাকবে, সেসব স্থানে ইউসিজি স্থাপন করা যাবে, যা দেশের বিদ্যমান জ্বালানি সমস্যার সমাধানে অত্যন্ত যৌক্তিক একটি সমাধান নিয়ে আসতে পারে।