উখেংচিং মারমা। খাগড়াছড়ি মং সার্কেলের অষ্টম রানী। যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি বা এমআইটিতে সুযোগ পাওয়া পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর প্রথম তরুণী। পড়বেন কগনিটিভ সায়েন্স নিয়ে।
গত ২৮ আগস্ট ওরিয়েন্টেশনের মধ্য দিয়ে এমআইটির শিক্ষাজীবন শুরু হয় উখেংচিং মারমার। খাগড়াছড়ির মহালছড়ির চোংড়াছড়ি থেকে যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি বা এমআইটিতে বৃত্তি নিয়ে পড়ার সুযোগ পেয়েছেন পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর প্রথম তরুণী উখেংচিং মারমা।
খাগড়াছড়ির মহালছড়ির চোংড়াছড়ি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তাঁর লেখাপড়া শুরু। এরপর নতুন কুঁড়ি ক্যান্টনমেন্ট হাই স্কুল থেকে ২০০৯ সালে এসএসসি পাস করে ২০১১ সালে এইচএসসি শেষ করেন খাগড়াছড়ির ক্যান্টনমেন্ট কলেজ থেকে। এইচএসসির পরে চলে আসেন গাজীপুরে। ভর্তি হন বঙ্গবন্ধু কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে। মাস তিনেক সেখানে পড়ার পরে সুযোগ পেয়ে যান চট্টগ্রাম এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব উইমেনসে। এ বিশ্ববিদ্যালয়ই মূলত বদলে দেয় উখেংচিংকে। নিজের স্বপ্ন পূরণের পথ খুঁজতে থাকেন এখান থেকে। ২০১৭ সালে স্নাতক শেষ করার আগেই ২০১৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের মিনেসোটায় সেন্ট ক্যাথরিন বিশ্ববিদ্যালয়ে গ্লোবাল আন্ডারগ্র্যাজুয়েট প্রোগ্রামের আওতায় এক সেমিস্টারে পড়তে যান। তারপর জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির সঙ্গে যুক্ত হয়ে কক্সবাজারে কাজ শুরু করেন। ২০১৯ সালে কানাডার ব্রিটিশ কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটির একটি কোর্সে ভর্তি হন। সর্বশেষ গত ২৮ আগস্ট ওরিয়েন্টেশনের মধ্য দিয়ে এমআইটির শিক্ষাজীবন শুরু হয় উখেংচিং মারমার।
কী পড়বেন এমআইটিতে?
পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর নারী-পুরুষের মধ্যে উখেংচিংই প্রথম এমআইটিতে পড়ার সুযোগ পেয়েছেন। এমআইটিতে লিঙ্গুইস্টিক অ্যান্ড ফিলোসফি বিষয়ে মাস্টার্স করবেন তিনি; সঙ্গে দুই বছরের ফেলোশিপ। পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর ভাষা, কৃষ্টি ও সংস্কৃতি সংরক্ষণে টেকনোলজিকে কীভাবে কাজে লাগানো যায়, টেকনোলজির বাইরে আর কী কী করা দরকার, সে বিষয়েও গবেষণা করতে চান উখেংচিং।
ঢাকার মার্কিন দূতাবাসের অভিনন্দন
এমআইটিতে সুযোগ পাওয়ার পর উখেংচিংকে অভিনন্দন জানিয়ে ঢাকার মার্কিন দূতাবাস তাদের অফিশিয়াল ফেসবুক পেজে লেখে- আসুন, আমরা রানী উখেংচিং মারমাকে অভিনন্দন জানাই! তিনি বাংলাদেশি আদিবাসী জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্বকারী প্রথম তরুণী, যিনি যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টনে অবস্থিত ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে স্নাতকোত্তর কার্যক্রমে ভর্তি হয়েছেন। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ডিপার্টমেন্ট অব স্টেটের শিক্ষা ও সংস্কৃতিবিষয়ক ব্যুরোর সহায়তাপুষ্ট গ্লোবাল আন্ডারগ্র্যাজুয়েট এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রামের শিক্ষার্থী ছিলেন।
২৫ হাজার স্যানিটারি প্যাড ও বিশ্বের ১৭ তরুণের তালিকায়
সামাজিক যে কোনো কাজে খুঁজে পাওয়া যায় উখেংচিংকে! করোনায়ও ছিলেন পাহাড়ি মানুষের পাশে। পাহাড়ে বেড়ে ওঠা কিশোরীদের প্রজনন স্বাস্থ্য সুরক্ষায় কাজ করেছেন উখেংচিং। ব্র্যাকের সহযোগিতায় খাগড়াছড়িতে মেয়েদের মধ্যে ২৫ হাজার স্যানিটারি প্যাড দিয়েছেন উখেংচিং। ২০১৭ সালে এশিয়া অঞ্চলের ‘কমনওয়েলথ ইয়াং পারসন অব দ্য ইয়ার’ হিসেবে ১৭ জনের চূড়ান্ত তালিকায় স্থান পেয়েছেন উখেংচিং মারমা। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা পূরণে অনুপ্রেরণামূলক কাজের জন্য কমনওয়েলথ সারাবিশ্বের যুবব্যক্তিত্বদের মধ্য থেকে এ তালিকা তৈরি করে। স্যানিটারি প্যাডের বাইরে খাগড়াছড়িতে ৭০০ কিশোরীকে নিয়ে ঋতুস্রাব বা মাসিকের সময়কালে স্বাস্থ্য ও পরিচ্ছন্নতা সম্পর্কে সচেতন করেছেন। এর ফলে কিশোরীরা প্রজনন স্বাস্থ্য সুরক্ষায় সচেতন হয়েছে। বিশুদ্ধ পানি ও স্যানিটেশন নিশ্চিতকরণ টেকসই উন্নয়ন বা এসডিজির অন্যতম লক্ষ্য। এ লক্ষ্য পূরণে উদ্যোগী হওয়ায় তিনি এই মনোনয়ন পান। এ ছাড়া ২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষে যুক্তরাষ্ট্রের গ্লোবাল আন্ডারগ্র্যাজুয়েট এক্সচেঞ্জ স্টুডেন্ট প্রোগ্রামের অধীনে বিশ্বের ৬০ দেশের নির্বাচিত ২৫০ শিক্ষার্থীর একজন ছিলেন তিনি।
যেভাবে রানী হলেন
২০২০ সালে বিয়ের পিঁড়িতে বসেন উখেংচিং মারমা। বর খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলার মং সার্কেল চিফ রাজা সাচিং প্রু চৌধুরী। এ বিয়ের মাধ্যমেই তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামের মং সার্কেলের অষ্টম রানী হয়ে গেলেন। পার্বত্য তিন জেলা তিন সার্কেলে বিভক্ত। এর মধ্যে রাঙামাটি চাকমা সার্কেল, বান্দরবান বোহমং সার্কেল এবং খাগড়াছড়ি মং সার্কেলে পড়েছে।
বাবা অংক্যজাই মারমার কাছে উখেংচিং
উখেংচিং মারমার বাবা অংক্যজাই মারমার কাছে মেয়ের এই অর্জন সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘উখেংচিংয়ের জন্মের পর থেকেই বুঝেছি যে, মেয়ে অন্য আট-দশটি শিশুর চেয়ে আলাদা। তাই তার প্রতি আমাদের বিশেষ আকর্ষণ কাজ করত। সবকিছুতেই সে একটু এগিয়ে থাকত। শৈশব-কৈশোরের গণ্ডি পেরোনোর পর আমাদের সেই ধারণো আরও পরিস্কার হয়ে গেল। সর্বশেষ সে এশিয়ান উইমেন ইউনিভার্সিটি থেকে ভালো ফলাফলের পর পুরোপুরিই মিলে গেল আমাদের হিসাব। এখন সে এমআইটিতে পড়ছে; বাবা হিসেবে এমন সংবাদ আমাকে আনন্দিত না করে পারে?’
আগামীর স্বপ্ন
আগামীর স্বপ্ন নিয়ে উখেংচিং বলেন, ‘সামনে আমার জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ অপেক্ষা করছে। সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে কাজের মাধ্যমে বিশ্বের বুকে বাংলাদেশের নাম উজ্জ্বল করতে চাই।’ এ ছাড়া উচ্চশিক্ষা শেষে দেশে ফিরে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করতে চান উখেংচিং। পাহাড়ি মানুষের পানি ও স্যানিটেশন, ভাষাগত সমস্যা নিয়েও কাজ করতে চান তিনি।