সম্প্রতি সড়কপথে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বেশ কয়েকটি জেলা ঘুরে এসেছি। ওই অঞ্চলের একজন সহকর্মীকে সঙ্গে নিয়ে ফরিদপুর, মাগুরা, যশোর, ঝিনাইদহ ও কুষ্টিয়া সফরকালে গ্রামীণ বাংলাদেশের একটা অংশ দেখার সুযোগ হয়েছে। গাড়ি করে ভ্রমণকালে আমরা বিভিন্ন জায়গায় থেমেছি, ঘুরে বেড়িয়েছি। এরই মাঝে স্থানীয়দের সঙ্গে খোশগল্পে মেতে উঠেছি। কুষ্টিয়ার কাতালমারী গ্রামের একজন কৃষক এ দেশের কৃষির ভবিষ্যৎ নিয়ে কথা বলেছেন, যার চিন্তাধারার গভীরতা আমাকে বিস্মিত করেছে। মাগুরার একজন তরুণ উদ্যোক্তা যখন আমাকে তার ব্যস্ততার বর্ণনা দিচ্ছিলেন, তখন গ্রামের এযাবত্কালের তরুণদের সম্পর্কে আমার মনে তা নতুন ধারণার জন্ম দিয়েছে। গ্রামের বাসিন্দাদের কথা শুনে আমি সমৃদ্ধ হয়েছি। তবে প্রকৃতপক্ষে কোনটি গ্রাম এবং কোনটি নগরকেন্দ্র, তা বুঝে উঠতে পারছিলাম না।
বাংলাদেশে গ্রামীণ রূপান্তর নতুন নয়। বলতে গেলে, প্রথম রূপান্তরটা ঘটেছে আশি ও নব্বইয়ের দশকে। রূপান্তরের নানা দিক আছে। ১৯৭৭ সালে প্রতিষ্ঠা লাভ করে বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (বিআরইবি)। ১৯৮০ সালের দিকে গ্রাম পর্যায়ে বিদ্যুৎ সংযোগ স্থাপন হতে শুরু করে। সে সময় কৃষিজমিতে প্রথমে ইলেকট্রিক ওয়াটার পাম্প এবং পরে শ্যালো মেশিন দিয়ে যন্ত্রচালিত সেচ শুরু হয়। এর মাধ্যমে শস্য উৎপাদন প্রক্রিয়া আরো সহজ হয়। বিশেষ করে বিভিন্ন কৃষি যন্ত্র, যেমন—পাওয়ার টিলার, ট্রাক্টর, স্বয়ংক্রিয় শস্য রোপণের ব্যবস্থা প্রসার পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কৃষি উৎপাদনশীলতা ব্যাপক মাত্রায় বৃদ্ধি পেতে শুরু করে। আশির দশকের শেষ এবং নব্বই দশকের প্রথম দিকে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগের (এলজিইডি) নেতৃত্বে বিস্তৃত গ্রামীণ সড়ক নেটওয়ার্ক গড়ে ওঠে। ফলে গ্রামাঞ্চলগুলোর সঙ্গে বিভিন্ন শহর কেন্দ্রের সংযোগ স্থাপন হয়। একই সময়ে গ্রামীণ দারিদ্র্য বিমোচনে ক্ষুদ্র ঋণের প্রসার শুরু হয়, যা স্বল্প আয়ের মানুষের জন্য বড় হাতিয়ার হয়ে ওঠে। অন্যদিকে বৈদেশিক কর্মসংস্থান ঘটে অনেক মানুষের। তারা মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে পাড়ি জমান। এসব অভিবাসী কর্মীর পাঠানো রেমিট্যান্স গ্রামীণ অর্থনীতির চাকা ঘুরিয়ে দেয়। এরপর প্রশাসনিক ইউনিট হিসেবে উপজেলা ব্যবস্থার প্রবর্তন ছিল আরো একটা পরিবর্তনের প্রেক্ষাপট। সব মিলিয়ে ২০০০ সালে এসে গ্রামীণ বাংলাদেশের রূপান্তর বাস্তবতায় রূপ নেয়।
আমার সাম্প্রতিক সফরে আমি গ্রামীণ বাংলাদেশের রূপান্তরের বিষয়গুলো দ্বিতীয় ধাপে অন্বেষণ করতে আগ্রহী ছিলাম। ২০০০-২০ সালের মধ্যে যা ঘটেছে, সে ব্যাপারে আমার পৃথক ছয়টি পর্যবেক্ষণ তুলে ধরছি।
প্রত্যন্ত গ্রামের অবসান: গ্রাম শব্দটা শুনলেই আমাদের মানসপটে একটি প্রত্যন্ত এলাকার ছবি ভেসে ওঠে। তবে আমরা সে সময়টাকে পেছনে ফেলে এসেছি। প্রথাগত সে ধ্যানধারণার সমাপ্তি ঘটেছে। বাংলাদেশের প্রান্তিক এলাকাগুলোর গভীরেও এখন সড়ক যোগাযোগ স্থাপিত হয়েছে। মোটরবাইক বা নসিমন-করিমনের সাহায্যে কয়েক মিনিট সময়েই শহরতলি থেকে শহরে যাতায়াত করা যায়। সড়কের উন্নয়ন, মোটরচালিত যানবাহন, মুঠোফোন, টেলিভিশন এবং অন্যান্য পরিবর্তনের ফলে ‘প্রত্যন্ত গ্রাম’-এর ছবি আমাদের চিন্তা থেকে বদলে গিয়েছে। এমনকি গ্রামের মানুষও এখন নিজেদের আলাদা ভাবেন না; তারাও জানেন যে গ্রাম ও শহরের মধ্যকার সীমারেখা ক্রমে মুছে যাচ্ছে। এটি একই সঙ্গে বাস্তবিক ও মানসিক রূপান্তর, যা গ্রামাঞ্চলের মানুষের চিন্তাচেতনাকে নতুনভাবে গড়ে দিচ্ছে, এমনকি নিজেদের প্রতিচ্ছবিকেও। তাদের এ নিজস্ব প্রতিচ্ছবি এবং আত্মসচেতনতা প্রভাব ফেলছে কাজের ওপর সেটি কি কৃষিকাজ নাকি ভিন্ন কিছু হবে।
অকৃষি কাজে নতুন মাত্রা: গ্রামীণ এলাকাকে এতদিন কৃষিকাজের প্রাণকেন্দ্র হিসেবে দেখা হতো। এখন নানা ধরনের অকৃষি কর্মকাণ্ডের বিস্তার আগের সেই ধারণা বদলে দিচ্ছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ২০১৬-১৭ সালের শ্রমশক্তি জরিপের তথ্য বলছে, গ্রামীণ কর্মসংস্থানে অকৃষি কাজের পরিমাণ শতকরা ৫৯ শতাংশ, ২০১০ সালের তুলনায় এটি বড় পরিবর্তন। এ পরিসংখ্যান আরো ঊর্ধ্বমুখী হচ্ছে। তবে কোন কোন মাধ্যমে এমনটা ঘটছে, এর সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষাভাবে কৃষির সম্পৃক্ততা কতটুকু, সে ব্যাপারে প্রশ্ন থেকে যায়।
এবারের সফরে আমি দেখেছি, স্থানীয়ভাবে উৎপাদন করা বা আমদানি করা কৃষিযন্ত্রের ভাড়াভিত্তিক ব্যবসা এখন বেশ জনপ্রিয়। লাঙল যেন এখন জাদুঘরে রাখার সময় এসেছে। গ্রামের বাজারে মোবাইল ও নানা ধরনের ইলেকট্রনিক যন্ত্র সারাইয়ের দোকানের ছড়াছড়ি। পরিবহন, নির্মাণ সামগ্রী, স্যানিটারি সরঞ্জাম, গ্যাস স্টোভ এবং আসবাবপত্রের দোকান এখন সেখানে অর্থনীতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। বাণিজ্যিক উদ্যোগ হিসেবে বসতভিটার উঠোন ও ছাদে বনায়নও অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখছে। সামাজিক আড্ডার স্থানে পরিণত হয়েছে চায়ের দোকান বা ছোট ছোট হোটেল-রেস্তোরাঁ।
গ্রামীণ উদ্যোক্তাদের চিত্র: গ্রামের অনেক তরুণই এখন উদ্যোক্তা হয়ে উঠেছেন। তারা বহুমুখী কাজে জড়িত বলা চলে। আমি এমন অনেক গ্রামবাসীর দেখা পেলাম, যারা একাধিক কাজে জড়িত। তারা কৃষিকাজ ও অকৃষিকাজ এক সঙ্গেই চালাচ্ছেন। মাগুরার শিবরামপুর গ্রামের তরুণ পলাশ সদরের সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে দলিল লেখক হিসেবে কর্মরত। চাকরির পাশাপাশি তিনি অন্যের জমি বর্গা নিয়ে সেখানে পেয়ারা, ড্রাগন ফল, লেবু ও কলা চাষ করছেন। তার নিজের সাতটি গরু রয়েছে। ভোরে ও সন্ধ্যায় তিনি তার গরুগুলোর দেখাশোনা করেন। দুধ বিক্রি করেও আয় হয় পলাশের। কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলার ববিতা দেবনাথও একজন উদ্যোক্তা। তিনি বিশ্বখ্যাত কনভেনিয়েন্ট স্টোর ‘সেভেন ইলেভেন’’-এর আদলে গ্রামেই একটি দোকান চালান, যেখানে নিত্যপ্রয়োজনীয় সব পণ্যের পসরা সাজিয়ে বসেন। মাপ্পি নামের এক তরুণ উদ্যোক্তার সঙ্গেও কথা হলো, টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ডিপ্লোমা সম্পন্ন করার পর এ তরুণ ঢাকায় কয়েক বছর চাকরি করেছেন। এরপর নিজ গ্রামে ফিরে এসে সফল ব্যবসায়ী হয়ে উঠেছেন তিনি। গ্রামের মানুষকে বিভিন্ন ধরনের ডিজিটাল অ্যাপ্লিকেশন পূরণে সহায়তা করছেন, যার ওপর নির্ভরশীল আশপাশের কয়েক গ্রামের মানুষ। উদ্যোক্তা হওয়ার নতুন এ সংস্কৃতি, প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স, কৃষিকাজের বাইরে আরো বহুমুখী কাজে জড়িত হওয়ার আকাঙ্ক্ষা, সরকারের নানা উদ্যোগ ও বিভিন্ন এনজিওর তত্পরতা, পাশাপাশি সেবায় ডিজিটাল ব্যবস্থা যোগ হওয়া যেমন মোবাইল ব্যাংকিং, এসব বিষয়ের ফলে আমূল বদলে যাচ্ছে গ্রামীণ অর্থনীতি।
গ্রামীণ মধ্যবিত্ত শ্রেণীর উত্থান: গ্রামীণ মধ্যবিত্ত শ্রেণীর উত্থান বাংলাদেশের গ্রামগুলোর সামাজিক দৃশ্যপট বদলে দিয়েছে। সম্প্রদায়ভিত্তিক মনোভাবের পাশাপাশি শহুরে, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী, ভোগবাদী জীবনধারার মিশেলে বিভাজিত এ শ্রেণী অন্যের প্রতি সহনশীল হলেও চারদিকে উঁচু দেয়ালঘেরা ইটের দালান তৈরিতে মনোযোগী হচ্ছে। তাদের মধ্যকার শ্রেণীবিন্যাস হচ্ছে বিভিন্ন ইরেকট্রনিক যন্ত্র দ্বারা। যেমন টেলিভিশন, ফ্রিজ ইত্যাদি। এক মাস আগে দক্ষিণ চট্টগ্রামের চন্দনাইশ উপজেলা থেকে ফেরার পথে দেখলাম, একজন ভ্যানচালক গ্রামের কোনো এক দোকানের জন্য বেশকিছু নতুন ওয়ালটন টেলিভিশন নিয়ে যাচ্ছেন। তবে শহরের মানুষের মতো গ্রামের মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মাঝেও এক ধরনের সংকোচ বা লজ্জাবোধ কাজ করে। সাতক্ষীরার একটি গ্রামের চায়ের দোকানে আমি ২০ জন মানুষের সঙ্গে গল্প করেছি। তাদের জমায়েতে প্রশ্ন করেছি, কাদের বাড়িতে টিভি বা ফ্রিজ আছে। হাত তুলতে অনুরোধ করার পরও কেউ হাত তোলেননি। পরে এক ব্যক্তি আমাকে চুপিসারে বললেন, তারা কেউ তাদের পরিবারের আর্থিক অবস্থা প্রকাশ করতে চায় না। তারা মনে করে এতে প্রতিবেশীদের কাছে তাদের সামাজিক অবস্থান খর্ব হবে, কিংবা অন্যের মনে ঈর্ষা জন্মাবে। দাঁত মাজার কাজে মাজন বা মেসওয়াকের ব্যবহার এখন প্রায় নেই বললেই চলে। এখন সবাই টুথপেস্ট ও টুথব্রাশ ব্যবহার করে। গ্রামের বাড়ি বা বিভিন্ন দোকানের দেয়ালে টুথপেস্টের বিজ্ঞাপন চোখে পড়ে, দোকানের তাকে থরে থরে সাজানো থাকে রঙবেরঙের টুথপেস্ট।
একটি নতুন ভূদৃশ্যের সূচনা: দিগন্তজোড়া সবুজ ধানের মাঠ, বৃক্ষশোভিত বসতভিটা এবং আঁকাবাঁকা খালের ঐতিহ্যবাহী গ্রামীণ দৃশ্য এখন বদলে গেছে। তার পরিবর্তে স্থান করে নিচ্ছে শহরের মতো অট্টালিকা। নির্মাণ শিল্পের বিকাশও গ্রামীণ জীবনের প্রকৃতি বদলে দিচ্ছে। শহরের মতো বিজ্ঞাপনের সংস্কৃতি ছেয়ে যাচ্ছে। বড় বড় বিলবোর্ড, বিভিন্ন উক্তিসংবলিত বিজ্ঞাপন, সিমেন্ট, বাল্ব, দেয়ালচিত্র, ফ্যান ইত্যাদি গ্রামবাসী ও পথচারীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছে। গ্রামীণ এলাকার পরিবেশ নীতি অনেকটাই বদলে যাচ্ছে বিভিন্ন ধরনের বাসাবাড়ি, বহুতল ভবন, কনভেনশন হল এবং অন্যান্য স্থাপনা নির্মাণের ফলে। পাশাপাশি ফায়ার স্টেশন, পেট্রল পাম্প, কোল্ড স্টোরেজ এবং বিভিন্ন কলকারখানা স্থাপিত হচ্ছে গ্রাম এলাকায়। যথাযথ ড্রেনেজ ব্যবস্থা, বর্জ্য সংগ্রহ ও প্রক্রিয়াকরণ, স্থাপনা নির্মাণের আইন, এসবের কোনোটিই না থাকার ফলে এক ধরনের বিশৃঙ্খলা দেখা দিচ্ছে। সহজ কথায় একে ‘জগাখিচুড়ি’ বলা যেতে পারে। এসব জটিল বিষয় সঠিকভাবে মোকাবেলার জন্য উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের কার্যালয় এবং ইউনিয়ন পরিষদগুলোর সক্ষমতা বাড়াতে হবে। গ্রামাঞ্চলের ‘গ্রামীণ’ পরিবেশের ক্ষতি বা কোনো ধরনের আপস না করে গ্রামের পরিবেশ ও প্রকৃতিগত চরিত্র বজায় রেখে সর্বোত্তম নাগরিক সেবা পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। এটিই হওয়া উচিত নীতিগত প্রশ্ন।
গ্রামীণ এলাকার ডিজিটালাইজেশন : সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সেবার অনলাইন সার্ভিসে সম্পৃক্ত হওয়ার সুযোগও গ্রামীণ জীবনে পরিবর্তন আনছে, যদিও গ্রামাঞ্চলের মানুষের মাঝে ডিজিটাল লিটারেসির হার খুবই কম। কভিড পরিস্থিতির আগে ২০১৯ সালে ব্র্যাকের বিআইজিডির করা এক জরিপে দেখা গেছে, গ্রামের অর্ধেক জনগোষ্ঠী ইন্টারনেটের সঙ্গে পরিচিত নয়। তবে কভিডকালীন লকডাউনের সময় এ পরিসংখ্যানে ব্যাপক পরিবর্তন আসে। মোবাইলভিত্তিক অনলাইন ক্লাস ডিজিটাল শিখনের ওপর একটা বড় প্রভাব ফেলেছিল। বিকাশ এবং নগদের মতো মোবাইল ব্যাংকিং সেবা মধ্যস্বত্বভোগীদের দূর করেছে। সরকার কর্তৃক গৃহীত ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ রূপরেখাকে কৃতিত্ব দিতেই হয়। গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের অধীন নগর উন্নয়ন অধিদপ্তরের মতে, বাংলাদেশের প্রায় ৭০-৭৫ শতাংশ জায়গায় এখন ডিজিটাল কেবল অবকাঠামো পৌঁছেছে। এ সম্প্রসারণশীল অবকাঠামো কাজে লাগাতে ডিজিটাইজ সেবা, ব্যবসা-বাণিজ্য, তথ্য বিনিময় এবং ডিজিটাল স্বাক্ষরতা হার বাড়ানোর মধ্যে মিথস্ক্রিয়া তৈরি করতে হবে।
আমি যখন গ্রামীণ রূপান্তরের দ্বিতীয় ধাপের সম্ভাবনা ও সংকট নিয়ে চিন্তা করছি, তখন আমার মনে নানা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। বাংলাদেশে কৃষির ভবিষ্যৎ কী এবং তা আগামীতে গ্রামীণ জীবনে কতটা প্রভাব ফেলবে? এর উত্তর নির্ভর করছে কাকে প্রশ্ন করছি তার ওপর। কাতালমারীর ওই কৃষকের কথা বারবার মনে পড়ে। তিনি বলেছিলেন, ‘শারীরিকভাবে যতদিন কর্মক্ষম থাকব, ততদিন আমি আমার জমি চাষ করব।’ আমি ধারণা করছি, কৃষির করপোরেট রূপান্তরের বিরুদ্ধে তার মতো কৃষক একাই লড়ে যাবেন। যশোরের খাজুরা গ্রামের এক পান ব্যবসায়ী ‘মাটির অভিশাপ’ সম্পর্কে সতর্ক করেছেন। তিনি যথার্থই বলেছিলেন, আমরা যদি নানা ফসল উৎপাদন করে জমির অতিব্যবহার করি, ভূমির সহনক্ষমতা নষ্ট করে ফেলি, তাহলে আমরা প্রকৃতির বিপদ ডেকে আনব।
অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে আমরা পরিবেশগত যে ক্ষতি ডেকে আনছি সে বিষয়ে গুরুত্ব দেয়া উচিত। গ্রামের রূপান্তর নিয়ে বিশদ গবেষণা হওয়া প্রয়োজন। উন্নয়নের ধরন-প্রকৃতি দেখে ধারণা জন্মায়, আজকের গ্রামীণ বাংলাদেশ হয়তো আগামীতে বিভিন্ন করপোরেট প্রতিষ্ঠানের জমি অধিগ্রহণের রাজনীতিতে ছেয়ে যাবে। বড় বড় প্রতিষ্ঠান তাদের কারখানা স্থাপনে গ্রামের দিকেই নজর দেবে। যন্ত্রের মাধ্যমে কৃষিপণ্যও ব্যাপক মাত্রায় উৎপাদন করবে তারা, কিন্তু সেখানে এখনকার কৃষকের মতো মানবিক ও আন্তরিক প্রচেষ্টা থাকবে কিনা জানা নেই। ভূমি দখল নিয়ে সামাজিক বিশৃঙ্খলা দেখা দিতে পারে। তবে আশাবাদী হওয়ার মতো একটি কথা দিয়ে শেষ করি, দ্বিতীয় পর্যায়ের গ্রামীণ রূপান্তর নিয়ে গবেষণার সুবর্ণ সময় এখনই। সেই গবেষণালব্ধ ফলের মাধ্যমে সব ইতিবাচক দিক গ্রহণ করে নেতিবাচক বিষয়গুলোকে বর্জনের উদ্যোগ নিতে হবে।
ড. আদনান জিল্লুর মোর্শেদ: স্থপতি, স্থাপত্য ইতিহাসবিদ, নগরবিদ ও অধ্যাপক; ওয়াশিংটন ডিসিতে অধ্যাপনা করেন এবং ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর ইনক্লুসিভ আর্কিটেকচার অ্যান্ড আরবানিজমের নির্বাহী পরিচালক