এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়, গত এক দশকে বাংলাদেশের গ্রামীণ অর্থনীতিতে যে ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে তা সত্যি অতুলনীয়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সুবিবেচনাপ্রসূত নীতি এবং সেগুলোর বেশির ভাগের সুদক্ষ বাস্তবায়নের ফলে বাংলাদেশের প্রায় সব গ্রাম এখন নগরের সঙ্গে যুক্ত হতে পেরেছে। একই সঙ্গে মানুষের নিজেদের উদ্যোগ, সামাজিক পুঁজির প্রয়োগ এবং অসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর সক্রিয়তার কথাও ভুললে চলবে না। ব্যক্তি খাতও কিন্তু পিছিয়ে নেই। গ্রামেও এখন সেবা খাতের তৎপরতা প্রায় সমান দৃশ্যমান। চায়ের দোকান, কফি শপ, রেস্তোরাঁ, সেলুন, বিউটি পার্লার, কিন্ডারগার্টেন স্কুল, কোচিং সেন্টার, হেলথ ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টার, সাইবার ক্যাফের উপস্থিতি এখন গ্রামাঞ্চলেও খুব স্বাভাবিক। জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে মাথাপিছু কৃষিজমির পরিমাণ কমেছে ঠিকই, কিন্তু সেবা খাতের ব্যাপক প্রসারের মাধ্যমে গ্রামাঞ্চলে অকৃষি কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে তা সামাল দেওয়া গেছে ভালোভাবেই। পরিসংখ্যান বলছে, এখন গ্রামীণ আয়ের ৬০ শতাংশ আসে অকৃষি খাত থেকে। নানামাত্রিক উদ্যোক্তারা এই অকৃষি খাতের সঙ্গে যুক্ত। তরুণ শিক্ষিত উদ্যোক্তারা, বিশেষ করে ডিজিটাল উদ্যোক্তারা এই খাতে এখন বেশি বেশি যুক্ত হচ্ছেন। অকৃষি খাতের এই উন্নতির পেছনে কৃষি খাতের ভূমিকাও কম নয়। উপকরণ সরবরাহ ও চাহিদার জোগান দিয়ে কৃষি অকৃষি খাতকে চাঙ্গা রাখছে। বস্তুত আমরা দুপায়েই হাঁটছি। আর পরিবর্তিত এই সব সূচকই বলে দিচ্ছে, আসলেই বাংলাদেশের দিন বদলেছে।
আমরা জানি যে বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে জীবনমানের যে অভূতপূর্ব উন্নতি হয়েছে, তার পেছনে কাজ করেছে কৃষির আধুনিকায়ন, যোগাযোগব্যবস্থার উন্নতি, অকৃষি খাতের বিস্তার, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির প্রসার এবং সর্বোপরি প্রবাস আয় বৃদ্ধি। তবে এই সব শক্তিকে একসূত্রে গাঁথতে বিশেষ ভূমিকা রেখেছে সরকারের যথাযথ সহায়তায় এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নেতৃত্বে পরিচালিত আর্থিক অন্তর্ভুক্তির অভিযান। এক যুগ আগে বঙ্গবন্ধুকন্যার দিনবদলের সনদ বাস্তবায়নের অঙ্গীকার নিয়ে আমরা বাংলাদেশ ব্যাংকের নেতৃত্বে যে আর্থিক অন্তর্ভুক্তির অভিযান শুরু করেছিলাম, তার পেছনে মূল ভাবনাটিই ছিল সামাজিক পিরামিডের পাটাতনে থাকা প্রান্তিক ও গ্রামীণ জনগণের কাছে সহজে উপযোগী আর্থিক সেবা পৌঁছে দেওয়া। উন্নয়নমুখী কেন্দ্রীয় ব্যাংকিংয়ের দর্শনের জায়গা থেকেই আমরা সর্বাত্মক কাজ করার চেষ্টা করেছি। চেষ্টা ছিল—১. কৃষি অর্থায়নে আনুষ্ঠানিক আর্থিক সেবাদাতাদের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি করার; ২. ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের বিকাশে সহায়ক নীতি প্রণয়ন ও তার বাস্তবায়ন তদারক করার; ৩. নারীর ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করতে কৃষি ও অকৃষি খাতে নারী উদ্যোক্তাদের জন্য অগ্রাধিকার ভিত্তিতে আর্থিক সেবা নিশ্চিত করার এবং ৪. প্রবৃদ্ধি যেন সবুজ তথা পরিবেশবান্ধব হয়, সেদিকে বিশেষ নজর রাখার। আর এই সব লক্ষ্য অর্জনে প্রধান হাতিয়ার হিসেবে সংগত কারণেই বেছে নেওয়া হয়েছিল সর্বাধুনিক ডিজিটাল আর্থিক প্রযুক্তির উদ্ভাবনী প্রয়োগকে। এর সুফলও আমরা দেখেছি। মাত্র অল্প কয়েক বছরের মধ্যেই দেশের আর্থিক খাতে ঘটে গেছে এক নীরব বিপ্লব।
সাম্প্রতিক দশকে আর্থিক অন্তর্ভুক্তি প্রসারিত হওয়ায় এ দেশে গ্রামীণ বাস্তবতায় নাটকীয় পরিবর্তন এসেছে, এ কথা সত্য। তবে স্বাধীনতার পরপরই কিন্তু উদ্ভাবনী আর্থিক অন্তর্ভুক্তি কর্মসূচিগুলোর কারণে গ্রামবাংলার ইতিবাচক পরিবর্তন আসতে শুরু করেছিল। শুরুটা হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর নেওয়া প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার হাত ধরেই। ওই পরিকল্পনায় মোট বিনিয়োগের ২৪ শতাংশই রাখা হয়েছিল কৃষি খাতের উন্নয়নের জন্য। গ্রামীণ অর্থনীতির রূপান্তরে ব্যক্তি খাতের অবদানও ছিল উল্লেখ করার মতো। তবে নতুন শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে এসে সরকারের যথাযথ নীতি সহায়তা এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সময়োপযোগী দিকনির্দেশনা এই খাতের বিকাশকে এক নতুন মাত্রা দিয়েছে। গত এক দশকে মাথাপিছু মাইক্রোফিন্যান্স প্রদানের পরিমাণ বেড়েছে তিন গুণেরও বেশি। ২০০৯-১০ অর্থবছরে মাথাপিছু মাইক্রোফিন্যান্স দেওয়া হয়েছিল প্রায় ১৪ হাজার টাকা। আর এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৪৫ হাজার টাকায়। ঋণ প্রদানের পরিমাণ বাড়লেও কিস্তির টাকা ফেরত পাওয়ার হার (রিকভারি রেট) ধারাবাহিকভাবে ৯০ শতাংশের ওপরেই ধরে রাখা গেছে। এ থেকে বোঝা যায় যে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মাইক্রোফিন্যান্স খাত আরো পরিণত হয়ে উঠছে। ফলে মাইক্রোফিন্যান্স প্রতিষ্ঠানগুলো নতুন নতুন উদ্ভাবনী কর্মসূচি নিয়ে হাজির হয়ে তাদের সেবার ব্যাপ্তি আরো বাড়াচ্ছে।
গ্রামাঞ্চলে আর্থিক অন্তর্ভুক্তি কিন্তু শুধু মাইক্রোফিন্যান্সেই আটকে নেই। বরং মূলধারার ব্যাংকিং সেবাও বিশেষ করে গত এক দশকে পৌঁছে দেওয়া গেছে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে বসবাসকারী প্রান্তিক মানুষের দোরগোড়ায়। বাংলাদেশের ব্যাংকের নেতৃত্বে সাম্প্রতিক দশকে পরিচালিত ব্যাপকভিত্তিক আর্থিক অন্তর্ভুক্তির অভিযানে প্রত্যন্ত অঞ্চলে বসবাসকারী এবং সচরাচর আনুষ্ঠানিক আর্থিক সেবার বাইরে থাকা নাগরিকদের কাছে সেবা পৌঁছে দেওয়াকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। সামাজিক পিরামিডের পাটাতনে থাকারাও যেন সহজে ব্যাংকিং সেবা পান সে জন্য এই সময়ে ১০ টাকার ব্যাংক হিসাব খোলা হয়েছে প্রায় দুই কোটি, কৃষিঋণের সরবরাহ বাড়ানো হয়েছে ১৩০ শতাংশ, বর্গাচাষিদের জন্য বিশেষ ঋণ প্রকল্পের আওতায় ১৬ লাখ কৃষিজীবীকে ঋণ দেওয়া হয়েছে (যাদের মধ্যে বড় অংশটিই নারী)। অকৃষি খাতকে সহায়তার লক্ষ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকে স্বতন্ত্র এসএমই বিভাগ খোলা হয়েছে, দেওয়া হয়েছে সুবিবেচনাভিত্তিক এসএমই অর্থায়নের গাইডলাইন। এসএমই অর্থায়নে বাংলাদেশ ব্যাংকের কার্যকর নির্দেশনা ও তদারকির ফলে ২০১০-১৭ সময়কালে ৪৫ লাখ এসএমইকে প্রায় ৯৪ বিলিয়ন ডলার ঋণ দেওয়া সম্ভব হয়েছে। এর একটি উল্লেখযোগ্য অংশ গ্রামের ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের কাছে গেছে; ফলে সেখানে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে, কমেছে কৃষির ওপর নির্ভরতা। এ ছাড়া সিএমএসএমই ঋণের ১৫ শতাংশ নারী উদ্যোক্তাদের দেওয়ার বাধ্যবাধকতা থাকায় এই সময়ে চার লাখের বেশি নারী উদ্যোক্তা পেয়েছেন ৩.৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণ। এসবের পাশাপাশি জামানতবিহীন হিসাবধারীদের জন্য ২৪ মিলিয়ন ডলারের পুনরর্থায়ন কর্মসূচি, ১৫ লাখ স্কুল ব্যাংকিং হিসাবের মতো উদ্যোগগুলোর সুফলেরও বড় অংশ গেছে গ্রামাঞ্চলে। যেমন—মাত্র ৪ শতাংশ হারে ভুট্টা ও মসলা চাষিদের ঋণের পুনরর্থায়নের সুযোগ তৈরি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব গ্রামীণ মৎস্য, মুরগি ও গবাদি পশুর উদ্যোগে ঠিকই পড়েছে।
গ্রামীণ অর্থনীতিতে ইতিবাচক রূপান্তরের জন্য উন্নয়নমুখী ব্যাংকিংয়ের এই সাফল্য নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয় এবং অনুসরণীয়। তবে একই সঙ্গে আমাদের নিজস্ব অভিজ্ঞতা থেকেই আমাদের শিখে শিখে আরো উন্নতি করতে হবে। গত ১০-১২ বছরের আর্থিক অন্তর্ভুক্তির অভিযান থেকে দেখতে হবে কোন উদ্যোগগুলো সবচেয়ে সফল হয়েছে এবং ওই সাফল্যের পেছনের কারণগুলোকে ভালোভাবে অনুধাবন করে তার ভিত্তিতে আগামী দিনের পথনকশা দাঁড় করাতে হবে। নিঃসন্দেহে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সামনেও রয়েছে অনেক চ্যালেঞ্জ। প্রবৃদ্ধির ধারা অটুট রেখে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখা, বাড়ন্ত আয়বৈষম্য, খেলাপি ঋণ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করেই আমাদের এগোতে হবে। ম্যাক্রো-অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা মাইক্রো-অর্থনীতির প্রসারে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। গ্রামীণ অর্থনীতির রূপান্তরের অগ্রযাত্রা দেশের সামষ্টিক অর্থনীতির বিকাশ ও স্থিতিশীলতার ওপর ভর করে আগামী দিনে আরো গতিময় হবে, সেই প্রত্যাশাই করছি।