Home » গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি : কিছু প্রস্তাব

গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি : কিছু প্রস্তাব

0 মন্তব্য 194 ভিউজ

গত শতাব্দীতে এই পৃথিবীতে অর্ধশতাধিক গণহত্যার ঘটনা ঘটেছে। এর ভেতর শতকরা ৮০ ভাগ গণহত্যার বিচার দূরে থাক, আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতিও মেলেনি। ১৯৭১ সালের বাংলাদেশের গণহত্যা গত শতাব্দীতে সংঘটিত নৃশংসতম গণহত্যাগুলোর একটি। প্রায় ৪০ বছর পর গণহত্যাকারীদের বিচার শুরু হলেও গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি এখনো সুদূরপরাহত।

২৫ মার্চ সরকারিভাবে গণহত্যা দিবস ঘোষণার জন্য আমরা প্রায় তিন দশক আন্দোলন করেছি। ১৯৯৩ সালে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ২৫ মার্চ গণহত্যার কালরাতের অনুষ্ঠানে আমরা বলেছিলাম, বাংলাদেশে ‘স্বাধীনতা দিবস’ আছে, ‘শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস’ আছে; কিন্তু যাঁদের রক্তের মূল্যে স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে সেই ৩০ লাখ শহীদকে স্মরণ করার কোনো সরকারি দিবস নেই।
ওই বছর ২৫ মার্চ শহীদ জননী জাহানারা ইমামের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের সমাবেশ থেকে আমরা দাবি করেছিলাম মুক্তিযুদ্ধের ৩০ লাখ শহীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর পাশাপাশি গণহত্যাকারীদের ধিক্কার জানানোর জন্য একটি দিবস পালন জরুরি এবং এর জন্য ২৫ মার্চ হচ্ছে সবচেয়ে উপযুক্ত। ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ৯ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস পালনের ঘোষণা দিয়েছে। ১৯৪৮ সালের ৯ ডিসেম্বর জাতিসংঘ ‘গণহত্যা কনভেনশন’ (কনভেনশন অন দ্য প্রিভেনশন অ্যান্ড পানিশমেন্ট অব দ্য ক্রাইম অব জেনোসাইড) ঘোষণা করেছিল। আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবসের ঘোষণায় জাতিসংঘ বলেছে, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গণহত্যায় নিহতদের স্মরণ ও শ্রদ্ধা জানানোর পাশাপাশি গণহত্যার বিরুদ্ধে সচেতনতা সৃষ্টির জন্য একটি দিবস পালন প্রয়োজন। জাতিসংঘের এই ঘোষণার পর ২৫ মার্চ ‘আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস’ হওয়ার কোনো সুযোগ না থাকায় আমরা এ দাবি থেকে সরে এসে ১৯৭১-এর ৯ মাসে বাংলাদেশে সংঘটিত গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির জন্য আন্দোলন করছি।
১৯৭১ সালের গণহত্যাকারীদের বিচারের উদ্যোগ গ্রহণ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার নিজ দেশে এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে অত্যন্ত প্রশংসিত হয়েছে। গত শতাব্দীতে যেসব দেশ ও জাতি গণহত্যার শিকার হয়েছে অথচ গণহত্যাকারীদের বিচার করতে পারেনি তারা এখন তাকিয়ে আছে বাংলাদেশে গণহত্যাকারীদের বিচারের সাফল্যজনক পরিসমাপ্তির দিকে।

আমরা আশা করব বিশ্বের বিভিন্ন দেশে চলমান গণহত্যার নিন্দা এবং গণহত্যার ভিকটিমদের প্রতি সহানুভূতি ও সহমর্মিতা প্রকাশ এবং গণহত্যাকারীদের বিচারের যৌক্তিকতা তুলে ধরার জন্য বাংলাদেশ সরকারিভাবে ৯ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস এবং বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে ২৫ মার্চ জাতীয় গণহত্যা দিবস পালন করবে।
২০১৭ সালের ১৯-২১ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত নির্মূল কমিটির সপ্তম জাতীয় সম্মেলনে গৃহীত প্রস্তাবে আমরা আবারও ২৫ মার্চ জাতীয় গণহত্যা দিবস এবং ৯ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস পালনের জন্য সরকারের প্রতি আহবান জানিয়েছিলাম। যার ধারাবাহিকতা ছিল এ বিষয়ে আমাদের ২০১৭ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির আলোচনাসভা ও গণহত্যাবিষয়ক গ্রন্থ প্রকাশ, যা বাংলাদেশের গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জনে সহায়ক হবে। এরপরই সরকার ২৫ মার্চ ‘জাতীয় গণহত্যা দিবস’ হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ২০১৭ সালের ১১ মার্চ জাতীয় সংসদে ‘২৫ মার্চ জাতীয় গণহত্যা দিবস’ রাষ্ট্রীয়ভাবে পালনের সর্বসম্মত প্রস্তাব গৃহীত হওয়ার ফলে বাংলাদেশের গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জনের পথ সুগম হয়েছে।

বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে গৃহীত প্রস্তাবে বলা হয়েছে, ২৫ মার্চ গণহত্যা দিবস পালনের পাশাপাশি এই দিবসের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির জন্য সরকার উদ্যোগ গ্রহণ করবে। আমরা জানতে পেরেছি, এরই মধ্যে সরকারের পক্ষ থেকে জাতিসংঘে চিঠিও দেওয়া হয়েছে। গণমাধ্যমের আলোচনায় আমরা দেখেছি ২৫ মার্চ আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবসের স্বীকৃতি অর্জনের জন্য বিজ্ঞজনরা নানা অভিমত ব্যক্ত করেছেন। আমরা পরিষ্কারভাবে বলতে চাই, ২৫ মার্চ আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস ঘোষণার সুযোগ আমরা ২০১৫ সালেই হারিয়ে ফেলেছি। আমাদের এখন প্রয়োজন একাত্তরের গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির জন্য সম্মিলিত উদ্যোগ গ্রহণ।

২০১৭ সালের ১৫ মার্চ আমরা পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর উপস্থিতিতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে পাঁচটি প্রস্তাব বিবেচনার জন্য প্রদান করেছি। এর ভেতর উল্লেখযোগ্য তিনটি প্রস্তাব ছিল—

১. বাংলাদেশের গণহত্যা সম্পর্কে একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটি ও মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরসহ অন্য গবেষকরা যা লিখেছেন সেগুলো এবং এতত্সংক্রান্ত আলোকচিত্র ও প্রামাণ্যচিত্র বাংলাদেশের সব কূটনৈতিক মিশন, বিদেশে আমাদের সব দূতাবাস, বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশ সম্পর্কে আগ্রহী আইনপ্রণেতা, গবেষক ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান, মানবাধিকার সংগঠন এবং জাতিসংঘের বিভিন্ন দপ্তরে পাঠানো প্রয়োজন।

২. বাংলাদেশের গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির জন্য বিভিন্ন দেশের সরকারকে আনুষ্ঠানিকভাবে অনুরোধ জানাতে হবে, যাতে তারা তাদের পার্লামেন্ট এই মর্মে একটি প্রস্তাব গ্রহণ করে। ভারত, নেপাল, ভুটান, রাশিয়া ও পূর্্ব ইউরোপের দেশগুলোসহ যেসব দেশ ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের গণহত্যার প্রতিবাদ ও নিন্দা করেছিল তাদের অনুরোধ করা হলেই এ বিষয়ে তারা পার্লামেন্টে প্রস্তাব গ্রহণে সম্মত হবে বলে আমরা বিশ্বাস করি। এ ছাড়া ইউরোপ, উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া ও এশিয়ার অন্যান্য দেশে বাংলাদেশের গণহত্যা সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টির জন্য পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় প্রবাসী বাঙালি এবং নির্মূল কমিটির মতো সংগঠনগুলোর সহযোগিতা চাইতে পারে।

৩. আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের বিস্মৃতপ্রায় গণহত্যা সম্পর্কে নতুন প্রজন্মকে আগ্রহী করার জন্য দেশে ও বিদেশে গণহত্যা বিশেষজ্ঞ, আইনপ্রণেতা, বুদ্ধিজীবী ও মানবাধিকার সংগঠনগুলোকে নিয়ে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সম্মেলন নিয়মিতভাবে আয়োজন করা প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে নির্মূল কমিটি উদ্যোগী ভূমিকা পালন করতে পারে।

দেশের মধ্যে নতুন প্রজন্মকে একাত্তরের গণহত্যা সম্পর্কে জানানোর জন্য এবং গণহত্যার বিরুদ্ধে গণসচেতনতা সৃষ্টির জন্য মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় এবং তথ্য মন্ত্রণালয়কে সমন্বিত কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের ৪৬ বছর পর নির্দিষ্ট দিবস পালনের মাধ্যমে একাত্তরের গণহত্যার সরকারি স্বীকৃতি প্রকৃতপক্ষে ৩০ লাখ শহীদের মহান আত্মদানের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি। এই স্বীকৃতি দেশে ও দেশের বাইরে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতকারীদের গণহত্যা অস্বীকারের অপচেষ্টা প্রতিহত করার ক্ষেত্রে সহায়ক হবে। একই সঙ্গে আমাদের নতুন প্রজন্মের আত্মপরিচয়ের সংকটও মোচন করবে। মুক্তিযুদ্ধোত্তর প্রজন্মকে জানতে হবে একটি ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য বাঙালি জাতিকে যে চরম মূল্য দিতে হয়েছে তা অন্য কোনো জাতিকে কখনো দিতে হয়নি।
একাত্তরের গণহত্যা হয়েছে ধর্মের নামে। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এবং তাদের সহযোগীরা ইসলাম রক্ষার দোহাই দিয়ে বাংলাদেশে ৩০ লাখ মানুষকে হত্যা করেছিল। ধর্মের নামে রাজনীতি নিষিদ্ধ না হলে গণহত্যার অভিশাপ থেকে যেমন মুক্তি পাওয়া যাবে না, একইভাবে বিশ্বশান্তিও নির্বিঘ্ন হবে না।

লেখক : একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি

আরও পড়ুন

মতামত দিন


The reCAPTCHA verification period has expired. Please reload the page.

আমাদের সম্পর্কে

We’re a media company. We promise to tell you what’s new in the parts of modern life that matter. Lorem ipsum dolor sit amet, consectetur adipiscing elit. Ut elit tellus, luctus nec ullamcorper mattis, pulvinar dapibus leo. Sed consequat, leo eget bibendum Aa, augue velit.