Home » বাণিজ্যিকীকরণের পথে সামুদ্রিক সম্পদ

বাণিজ্যিকীকরণের পথে সামুদ্রিক সম্পদ

0 মন্তব্য 207 ভিউজ

এক লাখ ১৮ হাজার বর্গকিলোমিটারের বেশি সমুদ্র এলাকা রয়েছে বাংলাদেশের। এই সমুদ্র অঞ্চলের সম্ভাবনা কাজে লাগানোর উদ্যোগ নিচ্ছে সরকার। এর অংশ হিসেবে নেদারল্যান্ডসের সহায়তায় সম্প্রতি একটি গবেষণা চালায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। গবেষণার ভিত্তিতে স্থানীয় বাজার পর্যালোচনা করে সি উইড বা সামুদ্রিক শৈবাল থেকে আগার-আগার পাউডার উৎপাদনে একটি বাণিজ্যিক মডেল প্রস্তুত করা হয়েছে। শিগগিরই একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করে সামুদ্রিক এ সম্পদের বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু করা যাবে বলে আশা করা হচ্ছে। এ আশার কথা জানিয়ে সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে চিঠি দিয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
চিঠিটিতে বলা হয়েছে, প্রধানমন্ত্রীর দিকনির্দেশনায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় নেদারল্যান্ডসের সরকার ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান এবিসিন্টের সহায়তায় দেশের সমুদ্র অঞ্চলে মেরিন জেনেটিক রিসোর্স নিয়ে গবেষণা সম্পন্ন করেছে। এতে দেখা গেছে, সমুদ্র অঞ্চলে প্রাপ্ত বহুসংখ্যক প্রজাতির সামুদ্রিক শৈবালের মধ্যে কয়েকটির ব্যাপক বাণিজ্যিক সম্ভাবনা রয়েছে। এটি দেশের সমুদ্র অর্থনীতি বা সুনীল অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারে।

গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের সমুদ্র অঞ্চলে পাওয়া সি উইড থেকে উৎপাদিত আগার-আগার পাউডার বেভারেজ, বেকারিসহ খাদ্যসামগ্রী, ওষুধ, প্রসাধনী, জৈব প্রযুক্তি ও পশুখাদ্য শিল্পে ব্যাপকভাবে ব্যবহারের সুযোগ রয়েছে। এসব শিল্পে দেশে প্রায় ২৮ হাজার কোটি টাকার কাঁচামালের বাজার রয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ২১ হাজার কোটি টাকার কাঁচামাল আমদানি করা হয়। সি উইড থেকে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে আগার-আগার পাউডার উৎপাদনের মাধ্যমে আমদানি কমিয়ে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয়ের পাশাপাশি বিদেশে রপ্তানিরও সুযোগ রয়েছে।

গবেষণার তথ্যের ভিত্তিতে স্থানীয় বাজার সম্ভাবনা পর্যালোচনা করে আগার-আগার পাউডার উৎপাদনের জন্য বাণিজ্যিক মডেল তৈরি করেছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সামুদ্রিক বিষয় ইউনিট। দেশের বেকারি শিল্পে বছরে প্রায় ৭০০ কোটি থেকে ১ হাজার কোটি টাকার আগার-আগারের চাহিদা রয়েছে। এ শিল্পে বছরে ১ হাজার ৬৩৬ থেকে ২ হাজার ৪৫৪ টন আগার-আগার পাউডার প্রয়োজন। তবে মডেলটিতে প্রাথমিকভাবে আগার-আগার প্লান্টে বার্ষিক ১৮০ টন উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে।

এ ছাড়া প্রস্তাবিত আগার-আগার প্লান্ট থেকে প্রাথমিকভাবে উপজাত হিসেবে প্রায় ৪৯০ টন সামুদ্রিক শৈবালভিত্তিক প্রোটিন উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। সামুদ্রিক শৈবাল থেকে প্রাপ্ত প্রোটিন বাজারের চাহিদা মেটাতে অন্যতম বিকল্প হতে পারে। দেশে শ্যাম্পু উৎপাদনের জন্য থিকেনিং এজেন্ট হিসেবে আগার-আগার পাউডারের বার্ষিক চাহিদা প্রায় ১৩০ কোটি টাকার। বিভিন্ন প্রসাধন শিল্পে অন্যান্য পণ্য প্রস্তুতকরণেও আগার-আগার ব্যবহার করা যেতে পারে।

গবেষণার প্রস্তাব অনুযায়ী, প্রাথমিকভাবে তিন বছর মেয়াদে এ প্রকল্প শুরু করা যেতে পারে। প্রয়োজনে মেয়াদ বাড়িয়ে পাঁচ বছর পর্যন্ত করা যেতে পারে। প্রথম তিন বছরে মোট বিনিয়োগের প্রয়োজন হবে প্রায় ৫০ কোটি টাকা। এ তিন বছরে মোট আয় হবে প্রায় ৮৮ কোটি টাকা। চতুর্থ বছর থেকে প্রতি বছর আয় হবে প্রায় ৮৮ কোটি টাকা করে।

এর আগে সরকার এ ধরনের বাণিজ্যিক কার্যক্রম বাস্তবায়ন করেনি। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কিছু বেসরকারি উদ্যোক্তার সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনা করেছে। ইতোমধ্যে ওলিয়া গ্রুপের প্রতিষ্ঠান ওলিয়া আগার-আগার ইন্ডাস্ট্রি এ কার্যক্রমে বিনিয়োগে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। প্রতিষ্ঠানটি প্রস্তাবিত প্রকল্প বাস্তবায়নে প্রসেসিং প্লান্ট স্থাপনের জন্য নিজস্ব অর্থায়নে কার্যক্রম শুরু করতে চায়।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলছে, বাণিজ্যিক ভিত্তিতে দৈনিক ৫০০ কেজি আগার-আগার পাউডার উৎপাদনের জন্য প্রতিষ্ঠানটিকে মহেশখালী চ্যানেলসহ সুবিধাজনক অব্যবহৃত যে কোনো জায়গা সি উইড ফার্মিংয়ের জন্য ২০ বছর বা তার বেশি সময়ের জন্য দেওয়া যেতে পারে।

প্রকল্প বাস্তবায়নের আগে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং ওলিয়া আগার-আগার ইন্ডাস্ট্রিজের মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষর হবে। অগ্রগতি মূল্যায়ন সাপেক্ষে তা পুনরায় নবায়ন করা হতে পারে। এ ছাড়া প্রতিষ্ঠানটিকে কারিগরি সহায়তা প্রদানে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং গবেষণা প্রতিষ্ঠান এবিসেন্টের মধ্যেও চুক্তি হবে। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে তা হবে সরকারের সুনীল অর্থনীতি-সংক্রান্ত কর্মকাণ্ডে একটি দৃশ্যমান মাইলফলক।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সামুদ্রিকবিষয়ক ইউনিটের সচিব রিয়ার অ্যাডমিরাল মো. খুরশেদ আলম সমকালকে বলেন, সামুদ্রিক সম্পদ বাণিজ্যিকীকরণের জন্য গবেষণার আলোকে প্রকল্প প্রস্তুত করে তাতে বিনিয়োগের জন্য বেসরকারি উদ্যোক্তাদের সঙ্গে বেশ কিছু দিন আলোচনা করা হয়। প্রথম দিকে বেসরকারি খাত খুব বেশি আগ্রহ দেখায়নি। পরে ওলিয়া গ্রুপ এ ক্ষেত্রে বিনিয়োগের আগ্রহ প্রকাশ করেছে। আশা করা হচ্ছে, শিগগিরই আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করে তারা বাণিজ্যিক উৎপাদনে যাবে।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের গবেষণা বলছে, জিলেটিনের বিকল্প হিসেবে খাদ্য ও পানীয়ের ফর্মুলেশন, মেডিকেল ও ডেন্টাল পণ্য উৎপাদনে বিশ্বব্যাপী আগার-আগারের ব্যবহার বাড়ছে। তাই এসব ক্ষেত্রে দেশের চাহিদা পূরণের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বাজারে রপ্তানির মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের সুযোগ রয়েছে। তা ছাড়া সি উইড পরিবেশবান্ধব হওয়ায় এর চাষ পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষাসহ উপকূলীয় এলাকা সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
গবেষণায় সম্ভাব্য ফার্মিং এলাকা হিসেবে সেন্টমার্টিন দ্বীপ, কক্সবাজার ও টেকনাফ উপকূলীয় অঞ্চল, বাঁকখালী-মহেশখালী নদীর মোহনা, মহেশখালী চ্যানেল, সোনাদিয়া চ্যানেল, কুতুবদিয়া চ্যানেল, কুয়াকাটা উপকূলীয় অঞ্চল, সুন্দরবন ম্যানগ্রোভ বন এলাকা ও দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলীয় অঞ্চলের চিংড়ি ঘের এলাকাকে চিহ্নিত করা হয়েছে।

গবেষণায় উঠে এসেছে, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সি উইড থেকে আগার-আগার তৈরির বাণিজ্যিক সম্ভাবনা উজ্জ্বল। আগার-আগার বহির্বিশ্বে চায়নিজ জিলেটিন বা জাপানি জিলেটিন নামেও পরিচিত। এটি শূকর বা অন্যান্য প্রাণিজ হাড় থেকে প্রস্তুতকৃত জিলেটিনের বিকল্প হিসেবে মুসলিম বিশ্বে সমাদৃত। এ ছাড়া মাইক্রোবায়োলজি, রেডিওলজি, ডেন্টাল প্রস্থেটিক্স, ফটোগ্রাফিক ইমালসন, ইলেকট্রোফোরেসিস, পাচনতন্ত্রের চিকিৎসা, থেরাপিউটিক এজেন্ট, ক্রোমাটোগ্রাফি, বায়োটেকনোলজি, ল্যাক্সেটিভ, অ্যান্টিবায়োটিক, ভিটামিন শিল্পেও আগার-আগারের ব্যবহার হয়।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলছে, সি উইডের চাষ-সংক্রান্ত কর্মকাণ্ডে ইতোমধ্যে উপকূলীয় জনগণ সম্পৃক্ত হয়েছে। এর বাণিজ্যিক উৎপাদনের মাধ্যমে নারীসহ অনেক মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ রয়েছে। তা ছাড়া সি উইড পরিবেশবান্ধব হওয়ায় এর চাষে কার্বন ডাই-অক্সাইড শোষণের মাধ্যমে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষাসহ উপকূলীয় এলাকা সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, টেকসই উন্নয়নে সমুদ্রসম্পদ ব্যবহার গুরুত্বপূর্ণ। সমুদ্রসম্পদ খাদ্যের পাশাপাশি জ্বালানিও সরবরাহ করে। বর্তমানে বিশ্বব্যাপী সাগর-মহাসাগরভিত্তিক অর্থনীতির ধারণা জনপ্রিয় হচ্ছে। বিশ্বের ৩০ শতাংশ তেল ও গ্যাস সম্পদের উৎস এটি। পাশাপাশি ৯০ শতাংশ পণ্যের বাণিজ্য হয় সমুদ্রপথে। বর্তমান বিশ্বের জনসংখ্যা ৮০০ কোটি এবং ২০৫০ সাল নাগাদ জনসংখ্যা হবে ৯০০ কোটি। এখনই প্রায় ৩৫ কোটি মানুষের খাদ্যের ঘাটতি রয়েছে বিশ্বে। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, বিশ্বের স্থলসম্পদ ব্যবহার করে এ ঘাটতি মোকাবিলা প্রায় অসম্ভব। তাই এই বিশাল জনগোষ্ঠীর খাবারের ঘাটতি মেটাতে সমুদ্রসম্পদ হতে পারে অন্যতম সহযোগী। বর্তমানে বিশ্বের মানুষের চাহিদার ১৫ শতাংশ প্রোটিন জোগান দিচ্ছে সামুদ্রিক মাছ, উদ্ভিদ ও প্রাণী।

আরও পড়ুন

মতামত দিন


The reCAPTCHA verification period has expired. Please reload the page.

আমাদের সম্পর্কে

We’re a media company. We promise to tell you what’s new in the parts of modern life that matter. Lorem ipsum dolor sit amet, consectetur adipiscing elit. Ut elit tellus, luctus nec ullamcorper mattis, pulvinar dapibus leo. Sed consequat, leo eget bibendum Aa, augue velit.