দৃষ্টিনন্দন, শৈল্পিক এবং একই সাথে শ্বাসরুদ্ধকর ফুটবলের পসরা সাজিয়ে প্রথমবারের মতো সাফ ফুটবলে চ্যাম্পিয়ন হয়ে ঐতিহাসিক কীর্তিগাথা রচনা করেছে বাংলাদেশ জাতীয় নারী ফুটবল দল। টানা পাঁচবারের চ্যাম্পিয়ন ভারতকে গ্রুপ পর্যায়ে ৩-০ গোলে হারায় বাংলাদেশ। সেমিফাইনালে ভুটানের জালে ৮ গোল দিয়ে ফাইনালে উঠে। ফাইনালে ৪ বারের রানার আপ স্বাগতিক নেপালকে ৩-১ গোলে হারিয়ে প্রথমবারের মতো চ্যাম্পিয়ন হয়েছে বাংলাদেশ।
জানপ্রাণ উজাড় করে খেলা বাংলার সোনার মেয়েদের হাত ধরে ১৯ বছর পর দক্ষিণ এশিয়ার ফুটবলে শিরোপা জয়ের স্বাদ পেয়েছে লাল-সবুজের দেশ।
কিন্তু আমাদের এই মেয়েদের ক’জনকে আমরা চিনি? না, বাংলার এই সোনার মেয়েদের নেই তেমন তারকাখ্যাতি, নেই কোন নামডাক, নেই তাদের পুরুষ খেলোয়ারদের মত বিলাস বহুল বাড়ি কিংবা গাড়ি। ২০১০ এ দক্ষিণ এশিয়ান ফেডারেশন গেমস ব্রোঞ্জ পদক এবং ২০১৬ তে সাফ মহিলা চ্যাম্পিয়নশিপ এ রৌপ্য পদক অর্জন করে অপ্রতিরোদ্ধ এই মেয়েদের কিংবা আমাদের নারী ফুটবলকে পরম যত্ন নিয়ে গড়ে তোলা কোচ গোলাম রব্বানি ছোটন- কারোর ভাগ্যেই কোন স্বীকৃতি জোটেনি, একটা জাতীয় ক্রীড়া পদক পর্যন্ত না। বিজয়ের পর দেশে ফিরে সামান্য একটা ছাদখোলা বাসে অভ্যর্থনা যাদের একমাত্র নিষ্পাপ চাওয়া, সেই মেয়েদের পরিচয় জানতে উৎসুক বাংলাদেশ।
শত বাঁধার দেয়াল পেরিয়ে নারী ফুটবলের আতুরঘর সেই কলসিন্দুর থেকে উঠে আসা একঝাক কিশোরী আজ লাল-সবুজের জার্সি গায়ে সবুজ মাঠে বাঘিনীর মত দর্পে বেড়াচ্ছে। আসুন, নামে এবং জার্সিতে নাম্বারে জেনে নেই আমাদের বাঘিনীদের পরিচয়।
জার্সি নম্বর ১ : রুপনা চাকমা। জন্মের আগেই তার বাবাকে হারানোর পর মায়ের অনুপ্রেরণাতে হাজারো সামাজিক প্রতিকুলতা এবং পারিবারিক অস্বচ্ছলতা অতিক্রম করে ফুটবল চালিয়ে যাওয়া আজকের রুপন চাকমা এক সম্পূর্ণ নতুন মানুষ। মাত্র ১৬ বছরে ফুটবল জগতে গোলকিপার হিসেবে আসা এই মেয়েটি রাঙামাটির বাসিন্দা। ২০১৬ থেকেই তার গোল সামলানোর অতুলনীয় পারফরম্যান্সের নজির এবারের সাফ চ্যাম্পিয়নশিপেও বিদ্যমান। ফাইনালে নেপালের তুমুল আক্রমণের বিরুদ্ধে রুপনা চাকমা জীবনের সেরা খেলাটা দিয়েছে!
জার্সি নম্বর ২ : শিউলি আজিম। ময়মনসিংহের কলসিন্দুরের মেয়ে শিউলির ফুটবলে হাতেখড়ি হয় কলসিন্দুর উচ্চ বিদ্যালয়। শিউলি আজিম সেন্ট্রাল ডিফেণ্ডার ও রাইট ব্যাক- দুই ভূমিকাতে খেলে সে। প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়কে আটকাতে শিউলির পারদর্শিতা তুলনাহীন। সেই সাথে পালটা আক্রমণেও দারুণ ভাবে উতরে যায় শিউলি।
জার্সি নম্বর ৩ : শামসুন্নাহার। কলসিন্দুরের থেকে আসা ডিফেণ্ডার শামসুন্নাহার আগে উইঙ্গার হিসেবে খেলতো, পরে কোচ তাকে ডিফেন্সে নিয়ে এসেছে। গতি ও ক্ষীপ্রতায় অপ্রতিরোধ্য এই লেফট ব্যাক শামুসুন্নাহার ডিফেন্স ও আক্রমণ দুটোই সমান তালে সামলাতে পারে। প্রতিপক্ষের ডিফেন্ডারদের জন্য খুব শামসুন্নাহার দলের একটি শক্তিশালী অস্ত্র।
জার্সি নম্বর ৪ : আঁখি খাতুন। সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরের এই দীর্ঘদেহী (৫ ফুট ৮ ইঞ্চি) সেন্ট্রাল ডিফেণ্ডার ২০১৭ সালের অনুর্ধ্ব-১৫ সাফ চ্যাম্পিয়ানশিপের সেরা খেলোয়াড় নির্বাচিত হইয়েছিলেন। দলের মাঝে রামোস নামে সে বেশ সুপরিচিত কেননা সেন্ট্রাল ডিফেণ্ডার হলেও মাঝে মধ্যে তাকে গোল করতেও দেখা যায়। যেমন – কর্ণার বা গোল পোস্টের বাইরে থেকে ফ্রিকিকের সময় দুর্দান্ত কিছু গোলের রেকর্দ আছে তার। এছাড়াও দুরপাল্লার শটেও গোল করেছে কয়েকবার। তবে আঁখি খাতুন মুল দায়িত্ব সেন্ট্রাল ডিফেন্সে দেয়ালের মত অভেদ্য সে।
জার্সি নম্বর ৫ : মাসুরা পারভিন। ডিফেন্ডার মাসুরা পারভিন সাতক্ষীরার মেয়ে। অসাধারণ পাসিং এবং সেন্ট্রাল ডিফেন্সে আঁখি খাতুনের পাশপাশি মাসুরা পারভিনও একজন শক্তিশালী সম্পদ যা আমাদের গোলকিপার রুপনা চাকমারজন্য আশীর্বাদ স্বরূপ। পাসিং, ডিফেন্স লাইন, মিড ফিল্ড হয়ে ফরোয়ার্ড মাসুরা পারভিনের পারদর্শিতা অসামান্য। এবারের চার আসরের সাফ চ্যাম্পিয়নশিপেও মাসুরা পারভিন দুটো গোল করেছেন।
জার্সি নম্বর ৬ : মনিকা চাকমা। বাংলাদেশের ফুটবলের মধ্যমণি মনিকা খাগড়াছড়ি জেলার লক্ষ্মীছড়ির দুর্গম পাহাড় বর্মাছড়ির মেয়ে। বাবা তার ফুটবল পছন্দ করতেন না, বাবার চোখ ফাঁকি দিয়ে পাড়ার ফুটবল খেলায় অংশ নিতেন বড়বোনের সাথে। দুর্দান্ত ড্রিবলিং, অসাধারণ ক্ষিপ্রতায় প্রতিপক্ষের রক্ষন দুর্গভেদ, এবং অতুলনীয় সব থ্রু দিয়ে এই মিডফিল্ডার জয় করে নিয়ছেন সকলের নজর। এমনকি বাদ যায় না দুরপাল্লার শটও। ২০১৯ সালে বঙ্গমাতা অনূর্ধ্ব-১৯ নারী আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে মঙ্গোলিয়ার বিপক্ষে যে গোলটি করেছিল ফিফা সেই গোলটিকে ‘জাদুকরী গোল’ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।
জার্সি নম্বর ৭ : সানজিদা আখতার। কলসিন্দুরের আরেকটি রত্ন এই সানজিদা আমাদের মাঝমাঠের আরেক জাদুকরী খেলোয়ার। ২০১৪ তে ফুটবলে পা রাখা দুর্দান্ত সানজিদা ২০১৫ তে নেপালে এএফসি ইউ-১৪ মেয়েদের আঞ্চলিক চ্যাম্পিয়নশিপ বাংলাদেশকে শিরোপা জয়ে অসামান্য ভুমিকা রাখে। এছাড়াও সে ইউ-১৭ জাতীয়-এর জন্য ৯ বার এবং ৪টি গোল করে। এই রাইট ব্যাক দ্রুতগতিতে ডিবক্সে ঢুকে যাওয়া এবং দারুণ সব ক্রস করার সুনাম রয়েছে।
জার্সি নম্বর ৮ : মারিয়া মান্ডা। ২০১১ সালে ফুটবলে হাতেখড়ি হওয়া মারিয়ার বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৫ দলের অধিনায়ক। তার নেতৃত্বেই অনূর্ধ্ব–১৯ নারী সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে ভারতকে হারিয়ে অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হয়েছে বাংলাদেশ। ২০১৪ সালে অনূর্ধ্ব-১৪ জাতীয় দলে ডাক পান মারিয়া। তাজিকিস্তানে অনুষ্ঠিত এএফসি অনূর্ধ্ব-১৪ আঞ্চলিক চ্যাম্পিয়নশিপে তার সহ-অধিনায়কত্বেই চ্যাম্পিয়ন হয় বাংলাদেশ। এরপর জায়গা করে নেন মূল জাতীয় দলে। দ্রুতগতিতে বক্সে ঢুকে যেতে এবং দুর্দান্ত সব পাস দিয়ে গোল করাতে জুড়িহীন মারিয়া। সেমি ফাইনালে সাবিনা খাতুনের ১ম গোলটি এসেছে মারিয়া মাণ্ডার এরকমই এক দুর্দান্ত থ্রুতে। সাবিনা, স্বপ্না, কৃষ্ণাদের এভাবেই বল বানিয়ে দেয়ার কাজটি করে যায় নিয়মিত মারিয়া।
জার্সি নাম্বার ৯ : কৃষ্ণা রানী সরকার। আমাদের নাম্বার নাইন স্ট্রাইকার কৃষ্ণা টাঙ্গাইলের এই মেয়ে সাবিনা খাতুনের পরে একমাত্র খেলোয়াড় হিসেবে দেশের বাইরে ভারতের লীগে খেলে এসেছে। ক্ষিপ্রগামী এবং বুদ্ধিমতী একজন স্ট্রাইকাররের সমস্ত গুন সম্পন্ন কৃষ্ণা বসুন্ধরা কিংসের হয়ে ২৫ ম্যাচে ৫০ গোল করেছে। সাফের এই আসরে গোল দিয়েছে ২টি। টাঙ্গাইলের মেয়ে হিসেবে, বিশেষ করে হিন্দু হিসেবে কৃষ্ণা রানী সরকারকে প্রচণ্ড প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবেলা করেই খেলতে হয়েছে। কিন্তু ফুটবলের প্রতি দারুণ ভালোবাসার কারণেই এসব প্রতিকুলতা দমিয়ে ন্রাখতে পারেনি কৃষ্ণাকে।
জার্সি নম্বর ১০ : সিরাত জাহান স্বপ্না। রংপুরের মেয়ে সিরাত জাহান স্বপ্না ক্যারিয়ের শুরুর দিকে বেশ আড়ালে থাকলেও এই সাফে সে তার পায়ের জাদু দেখিয়েছে মাথে। বাম দিক দিয়ে দ্রুতগতিতে আক্রমণ হানায় এবং দ্রুতগতিতে গোল করতে সিদ্ধহস্ত!
জার্সি নম্বর ১১ : সাবিনা খাতুন। ২০১৫ সাল থেকে আমাদের জাতীয় দলের অধিনায়ক। ২৮ বছর বয়সী সাবিনা দলের সবচেয়ে অভিজ্ঞ খেলোয়াড়, দলের সবার আইকন। ২০০৯ সাল থেকে সাতক্ষীরার সাবিনা খাতুন জাতীয় দলের হয়ে খেলছে এবং সেই বছরেই ঘরোয়া ফুটবল লীগে খেলা শুরু করেছিলো। প্রতিপক্ষের দুর্ভেদ্য দুর্গ পেরিয়ে ধুমধাম গোল করে দেয়া যেন তার কাছে কিছুই না, এ কারণে নাম হয়েছে গোলমেশিন। বাংলাদেশের জার্সিতে ৩১ গোল করে সর্বোচ্চ গোলদাতা সে। সাফের এই আসরেও দুই হ্যাট্রিকে ৮ গোল করে গোল্ডেন বুট জিতেছে।
সাইড বেঞ্চে আছেঃ
জার্সি নম্বর ১২ : মার্জিয়া আক্তার। কলসিন্দুরের এই মিডফিল্ডার অনুর্ধ্ব-১৪ এএফসি প্রতিযোগিতায় ৩ ম্যাচে ৪ গোল করেছিলো। ২০১৪ সালে জাতীয় লীগে সেই অল্প বয়সেই ময়মনসিংহ জেলা দলের অধিনায়কত্ব করে লীগসেরা খেলোয়াড় হয়।
জার্সি নম্বর ১৩ : নিলুফা ইয়াসমিন নীলা। কুষ্টিয়া শহরের থানাপাড়া এলাকার এই মেয়ে ডিফেণ্ডার হিসেবে খেলে।
জার্সি নম্বর ১৪ : সোহাগী কিসকু। ঠাকুরগাঁয়ের রানীসংকৈল উপজেলার রাঙ্গাটুঙ্গি গ্রামের মেয়ে। প্লেমেকার নারী ফুটবল লীগ ২০২০-২১ মৌসুমে মোস্ট ভ্যালুয়েবল প্লেয়ার নির্বাচিত হয়েছিলো সোহাগী।
জার্সি নম্বর ১৫ : স্বপ্না রানী। ঠাকুরগায়ের এক কৃষক পরিবারের এই মেয়ে বিকেএসপি দলের হয়ে ভারতের সুব্রত কাপ (অনুর্ধ্ব-১৭) খেলেছিলো যেখানে ৫ গোল ছিল তার। অনুর্ধ্ব-১৯ ফুটবলে ভারতের বিরুদ্ধে তার অভিষেক হয়, সেখানে গোল করে নজর কাড়ে।
জার্সি নম্বর ১৬ : আনাই মগিনী। খাগড়াছড়ির মেয়ে। রাইট ব্যাক পজিশনে খেলে।
জার্সি নম্বর ১৭ : ঋতুপর্ণা চাকমা। রাঙ্গামাটির মেয়ে সুপার সাব হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে, বদলি খেলোয়াড় হিসেবে নিয়মিত গোল করে ও গোল বানায়।
জার্সি নম্বর ১৮ : সাজেদা খাতুন। কলসিন্দুরের মেয়ে।
জার্সি নম্বর ১৯ : তহুরা খাতুন। কলসিন্দুরের মেয়ে। বয়স ভিত্তিক দলে দারুণ ড্রিবলিং আর দ্রুতগতি দিয়ে প্রতিপক্ষকে ব্যতিব্যস্ত রাখা তহুরা খাতুনকে মেসি বলে ডাকা হতো।
জার্সি নম্বর ২০ : শামসুন্নাহার জুনিয়র। কলসিন্দুরের মেয়ে২ ০১৪ সালে জিতেছিল গোল্ডেন বুট, আর ২০১৫ সালে জিতেছিল গোল্ডেন বল।
জার্সি নম্বর ২১ : ইতি রানী।
ইতিহাস গড়ে চ্যাম্পিয়ন হওয়া বাংলার সোনার মেয়েরা ভাসছেন প্রশংসার জোয়ারে। যেখানে বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনে চলছে ব্যর্থতার কালো অধ্যায়, হোক ছেলেদের ফুটবল, ছেলেদের ক্রিকেট, হকি বা অন্য খেলা। সেখানে বাংলার সোনার মেয়েরা ফুটবলে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে লাল-সবুজের পতাকা করে উড়িয়ে চলেছে সদর্পে। ‘হিমালয় জয়’ করায় সঙ্গতকারণেই গোটা দেশ ভাসছে আনন্দের জোয়ারে। আজ বিমানবন্দরে প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেল বরণ করবেন মেয়েদের। ছা্দ খোলা সহ মেয়েদের জন্য দেশজুড়ে রয়েছে আরো নানা আয়োজন।