বিএনপিকে উদ্দেশ্য করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, সুস্থ রাজনীতিতে সরকারের আপত্তি নেই । কিন্তু সাধারণ মানুষের ওপর কেউ চড়াও হলে তা সহ্য করা হবে না।
বোববার (৬ নভেম্বর) ঢাকার জাতীয় জাদুঘর মিলনায়তনে আওয়ামী লীগ আয়োজিত ‘অগ্নিসন্ত্রাসের আর্তনাদ: বিএনপি-জামাতের অগ্নিসন্ত্রাস, নৈরাজ্য ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের খণ্ডচিত্র’ শীর্ষক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী এ কথা বলেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২০১৩ ও ২০১৪ সালে বিএনপি-জামায়াতের চালানো অগ্নি সন্ত্রাসের কারণে দেশের প্রায় ৫০০ মানুষ আগুনে পুড়েছে। সাড়ে তিন হাজার মানুষ আহত হয়েছে। আমরা তাদের সহযোগিতা করে যাচ্ছি।
বক্তব্যে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমার খালি একটাই আহ্বান থাকবে দেশবাসীর কাছে, কেউ রাজনীতি করতে চায়, সুষ্ঠু রাজনীতি করুক। আমাদের আপত্তি নেই, কিন্তু আমাদের সাধারণ মানুষের গায়ে কেউ হাত দিলে তাদের রক্ষা নেই…এটা সহ্য করা যায় না। এটা কোনো মানুষ সহ্য করতে পারবে না।’
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে আর এ রকম চাই না। আমরা শান্তি চাই। দেশের উন্নতি চাই; মানুষের কল্যাণ চাই।’
‘রিফিউজি হিসেবে বিদেশে আশ্রয় নিয়ে থাকতে হলো। অর্থ নেই, সম্পদ নেই, কিচ্ছু নেই। আমাদের ওভাবেই জীবন কাটাতে হয়েছে।’
নিজের ওপরও বিএনপির সন্ত্রাসী আঘাত বারবার এসেছে অভিযোগ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘সেই গ্রেনেড হামলা থেকে বেঁচে গেছি…একবার না বারবার আঘাত এসেছে। জানি না, আল্লাহর কী ইচ্ছা! বারবার বাঁচিয়েছে আমার পার্টি।
কান্নাজড়িত কণ্ঠে মঞ্চে দাঁড়িয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এখানে কোনো ফরমাল বক্তব্য দেয়ার কিছু নেই। শুধু মানুষের কান্না, মানুষের যন্ত্রণা, মানুষের বেদনা—সেটাই আপনারা দেখেছেন। আমি একজন স্বজনহারা। আমি একই দিনে বাবা-মা-ভাই সব হারিয়েছিলাম। তাই আমি এদের কষ্টটা উপলব্ধি করতে পারি।’
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর অনেক সংগ্রাম শেষে দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়েছিল বলে জানান প্রধানমন্ত্রী।
তিনি বলেন, ‘আমরা রাষ্ট্র পরিচালনা শুরু করেছিলাম, মানুষের আর্থসামাজিক উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছিলাম। তখনই সরকার উৎখাতের নামে যে অগ্নিসন্ত্রাস, খুন ২০০১ সালে শুরু, আবার ২০১৩, ২০১৪, ২০১৫ সালে বারবার।
‘কীভাবে মানুষ পুড়িয়ে মারে? একটা গাড়িতে যাচ্ছে জীবন্ত মানুষগুলো। সেখানে আগুন ধরিয়ে মানুষকে হত্যা করা, কীভাবে মানুষ পারে এভাবে মানুষের ক্ষতি করতে? এটাই নাকি আন্দোলন। এ আন্দোলন তো কখনও দেখিনি।’
নিজের শৈশব থেকে আন্দোলন দেখে আসছেন জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘প্রত্যেক মিলিটারি ডিক্টেটরের বিরুদ্ধে আন্দোলনে শরিক হয়েছি। সেই আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছি, ইয়াহিয়া খানের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছি। জিয়ার বিরুদ্ধে আন্দোলন করা হয়েছে।
‘কই, আমরা তো কখনও এই কথা স্বপ্নেও ভাবিনি যে, পেট্রলবোমা দিয়ে বা অগ্নিসংযোগ করে সাধারণ মানুষকে হত্যা করে সেটা আন্দোলন করা হবে। বিএনপি ঘোষণা দিল অবরোধ, হরতাল, কিন্তু কাজ হলো কী মানুষকে হত্যা করা।’
২০১৩ সালে প্রায় ৩ হাজার ৬০০ মানুষকে বিএনপি-জামায়াত পেট্রলবোমা মেরে আহত করেছে বলে অভিযোগ করেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘২০১৪, ২০১৫তে করেছে। আর গাড়িগুলো সব পুড়িয়ে যাদের জীবন-জীবিকার সুযোগ, সেটাও শেষ করে দিয়েছে।
‘এই আন্দোলন কী রকম আন্দোলন, সেটা আমি জানি না। মানুষের জন্য আন্দোলন করতে হলে, মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হলে, মানবাধিকার রক্ষা করতে হলে, মানুষকে নিয়েই তো আন্দোলন করবে।’
আন্দোলনের নামে বিএনপি-জামায়াত ৫০০ মানুষকে খুন করেছে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের সাধ্যমতো চেষ্টা করেছি তাদের পাশে দাঁড়াতে। তাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছি; জীবন-জীবিকার ব্যবস্থা করেছি। যতটুকু পারি করেছি, কিন্তু যে মানুষগুলো আপনজন হারিয়েছে, তাদের সে ব্যথা, কষ্ট সেটা তো দূর করা সম্ভব না।
‘কারণ সেটা তো আমি বুঝি। যারা আগুনে পুড়েছে, কী অবস্থা একেকজনের। জীবনে কত স্বপ্ন ছিল, কত আকাঙ্ক্ষা ছিল। সেই আকাঙ্ক্ষাগুলো একে একে পুড়ে শেষ হয়ে গেছে। একে একে পুড়ে সব ধ্বংস।’
দেশবাসীর উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘ওই দুঃসময়ের কথা যেন কেউ ভুলে না যায়। প্রতিটা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছিল অস্ত্রের ঝনঝনানি। মেধাবীদের হাতে অস্ত্র তুলে দিয়ে, মাদক দিয়ে তাদের বিপথে ঠেলে দিয়েছে। পঁচাত্তরের পর থেকে তো এই চলছিল বাংলাদেশে। আওয়ামী লীগ আসার পরে না, আমরা কিছুটা স্থিতিশীলতা আনতে পেরেছি।
‘শিক্ষার পরিবেশ তৈরি করা, দেশের উৎপাদন বৃদ্ধি করা, দেশের মানুষের আর্থসামাজিক উন্নয়ন করা—যতটুকু সম্ভব আমরা কিন্তু করে যাচ্ছি। যেটুকু কাজ আমরা করে যাচ্ছি, মানবকল্যাণে।’
আন্দোলনের নামে এভাবে মানুষ পুড়িয়ে মারাকে চরম মানবাধিকার লঙ্ঘন বলেও মন্তব্য করেন সরকারপ্রধান।
তিনি বলেন, ‘তারই মাঝে এ ধরনের আঘাত চরম মানবাধিকার লঙ্ঘন করা। আজকে এদের নিজেদের বিচার নিজেদেরই হচ্ছে। বিচার হবেই। এটা বোধ হয় আল্লাহর তরফ থেকেই হবে এবং বিচার তো হয়েছে।
‘হয়তো প্রত্যেক কেসে বিচার চলছে না, কিন্তু যারা এ ধরনের অগ্নিসন্ত্রাসের সঙ্গে জড়িত, তাদের বিরুদ্ধে মামলা আছে, তাদের বিচারকাজও চলছে। অনেকে শাস্তিও পাচ্ছে, ভবিষ্যতেও পাবে, কিন্তু যারা হুকুমদাত্রী বা হুকুমদাতা, তাদের কথা আপনারা ভেবে দেখেন। আমি জানি না, মানুষ এদের পাশে কীভাবে দাঁড়ায়। তাদের কীভাবে সমর্থন করে, যারা এ ধরনের ধ্বংসাত্মক কাজ করতে পারে, আর মানুষকে এভাবে কষ্ট দিতে পারে।’
অনুষ্ঠানে বিএনপি-জামায়াতের অগ্নি সন্ত্রাসের একটি ডকুমেন্টারি প্রদর্শন করা হয়। তারপর আওয়ামী লীগের সভাপতি বিএনপির অগ্নি-সন্ত্রাসের ক্ষতিগ্রস্তদের সঙ্গে কথা বলেন। তাদের দুঃখ-কষ্টের কথা নিজে শুনেন এবং তাদের সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করেন। এসময় প্রধানমন্ত্রীকে কাছে পেয়ে অনেকেই কেঁদে দেন। আওয়ামী লীগের সভানেত্রীও আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন।